অনেকেই ভাবেন, বন্দুক-বোমা সরিয়ে রেখে যদি গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ করত সেনাবাহিনী! মনে হতে পারে, এমনটা তো 'ইউটোপিয়া'। বাস্তবে এমনটা হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই, এই পৃথিবীতে এমন দেশের সংখ্যা নেহাৎ কম নয় যাদের কোনো সেনাবাহিনীই নেই। একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র দেশ; অথচ তার কোনো সেনাবাহিনী নেই। কিন্তু দিব্যি টিকে আছে এই হিংসা-বিধ্বস্ত পৃথিবীতে। আসুন জেনে নেওয়া যাক তেমনই কয়েকটা দেশের কথা।
গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজের কথাই যখন উঠল, তখন প্রথমেই এসে যায় অ্যান্ডোরার কথা। ফ্রান্স আর স্পেনের মধ্যে থাকা একটি ছোট্ট দেশ অ্যান্ডোরা। এদের একটা সেনাবাহিনী আছে বটে, তবে তার কাজ শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করা। নিরাপত্তা সংক্রান্ত দায়িত্ব অনেকটাই ছেড়ে দেওয়া আছে ফ্রান্স আর স্পেনের হাতে। একসময় কিন্তু রীতিমতো ৬০০ সৈন্যের একটি বাহিনী ছিল এখানে। তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যুদ্ধ কী নির্মম! তারপর আর কোনোদিন কোনো যুদ্ধ করেনি এই বাহিনী। তবে কখনো কোনো রাষ্ট্রীয় সংকট উপস্থিত হলে দেশের সমস্ত মানুষকেই ডাক দেওয়া হয়। সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মানুষ মাতৃভূমি রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে পড়ে। এভাবেই তো দিব্যি চলে যাচ্ছে তাদের।
অথবা ধরা যাক, 'কিরিবাটি' দেশটির কথা। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে তৈরি এই দেশ। এখানকার সংবিধানের স্পষ্ট নির্দেশ আছে, কোনোরকম সামরিক বাহিনী রাখা যাবে না। প্রতিরক্ষার সমস্ত দায়িত্বই তাই পুলিশ বাহিনীর উপর। পুলিশের হাতেও অবশ্য খুব উন্নত কোনো অস্ত্রশস্ত্র থাকে না। বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে একটি মাত্র নৌকা। চারিদিকে সমুদ্রের মাঝে একটি দেশ, যেকোনো মুহূর্তেই কিন্তু কোনো দেশ আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার, এমন কোনো ঘটনাই ঘটে না সেখানে। বরং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো সাহায্যই করে থাকে এই ছোটো দেশটিকে।
সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য দিতে রাজি নয় ডোমিনিকার সংবিধানও। ১৯৮১ সালে একটি প্রস্তাবে প্রতিরক্ষা খাতে সমস্ত খরচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর তারপরেই সেনাবাহিনী কার্যত উঠে যায়। একদম স্থানীয় স্তরে কিছু বাহিনী প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। তবে এই দেশের ইতিহাস কিন্তু এমন নয়। ফ্রান্স আর ব্রিটেনের বহু রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের সাক্ষী ডোমিনিকা। এমনকি ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল যে সপ্তবর্ষের যুদ্ধ, তাও ঘটেছিল এই ডোমিনিকাকে ঘিরেই। সেই দেশে আর যুদ্ধ নেই। সরকার বলে দিয়েছে যুদ্ধের জন্য এক পয়সা খরচ করবে না। অতএব গোটা দেশটাই শুধু মেতে থাকে প্রকৃতির রূপ আর সংস্কৃতির রসের উদযাপনে। দেশেটা তো তার বর্ণময় প্রকৃতির জন্যই পরিচিত গোটা ইউরোপের কাছে।
যুদ্ধের ভয়াবহতা বিব্রত করেছে লিচেনস্টাইনকেও। অনেক আগের ঘটনা সেটা। ১৮৬৬ সালে এই দেশটার কাছেই ঘটলো অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়ার লড়াই লিচেনস্টাইন যদিও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু সেই যুদ্ধের বীভৎস চেহারা দেখেছ সামনে থেকে। আর তারপরেই তুলে দেওয়া হল এখানকার সেনাবাহিনী। প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর উপর। সাকুল্যে পুলিশ কর্মচারীর সংখ্যাও মাত্র ১২৫। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানকার অপরাধের হার আশ্চর্যজনকভাবে কম।
আর এতকিছুর মধ্যে ভ্যাটিকান সিটির কথাই বা ভুলি কী করে? পোপের বাসগৃহকে ঘিরে খ্রিস্টানদের আবেগের তো সীমা-পরিসীমা নেই। আর এই ছোট্ট স্বাধীন শহরটার কোনো সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনও নেই। কোনো দেশই আক্রমণ করার সাহস পাবে না। আর করলেও ইউরোপের সমস্ত খ্রিস্টানরা একসঙ্গে রক্ষা করবে ভ্যাটিকান সিটিকে। আর এমনিতেই তো ইতালির সেনাবাহিনী অলিখিত চুক্তি মেনেই এই শহরের নিরাপত্তার কাজ করে যায়।
পৃথিবীতে এমন কত দেশ আছে, যাদের কোনো সেনাবাহিনী নেই। জাতিপুঞ্জের কাছে সেইসব দেশের একটা তালিকাও আছে। আবার এমন দেশও আছে, প্রতিরক্ষার জন্য যারা অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল। কোস্টারিকা, আইসল্যান্ড, মনোকা -- এদের কারোরই নিজেদের দেশের প্রতিরক্ষার জন্য কোনো বাহিনী নেই। দিব্যি অন্য দেশের উপর দায়িত্ব দিয়ে বসে আছে।
আসলে দয়া নদীর রক্তাক্ত চেহারা দেখে শুধু সম্রাট অশোকই বিচলিত হননি, আজও যুদ্ধের বীভৎস চেহারা অনেককেই বিচলিত করে। জানি না কবে এমন দিন আসবে, যেদিন সমস্ত যুদ্ধ শেষে ইতিহাসে পরিণত হবে। আর মানুষ সেই ইতিহাস পড়বে আর ভাববে, ওরা কী বোকা ছিল! শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। অথচ জীবনে তো কত আনন্দ করেও বেঁচে থাকা যায়।