আগামী ১২ মার্চ ১ ঘণ্টা এগিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত ঘড়ি, কেন?

ঘড়ির কাঁটায় অ্যালার্ম দিয়ে শুয়েছিলেন ভোর ছটায়। ছটাতেই বেজেছে অ্যালার্ম। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাইরে পা রেখেই যদি দেখেন শহরের বড়ো ঘড়িতে বাজে ৭টা? চমকে যাবেন বইকি! গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ থাকলে, নাওয়া-খাওয়া ভুলেই দৌড় দেবেন অধিকাংশ মানুষ। তবে কি আপনার সাধের অ্যালার্ম ক্লকটার গণ্ডগোল নাকি শহরের বড়ো ঘড়িটার?

ভারতের মতো দেশ থেকে হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে হাজির হলে এমন ঘটনার শিকার হতে হবে বৈকি। না, আপনার ঘড়ি বিগড়ায়নি। বিগড়ায়নি টাউনক্লকটাও। আসলে গোটা দেশের টাইমজোনকেই এগিয়ে দেওয়া হয়েছে ১ ঘণ্টা। আর সেই কারণেই এই বিভ্রান্তির জন্ম। শুনতে একটু অবাক লাগলেও সত্যি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকায় প্রতি শীতের শেষে এবং শরতের শুরুতে বদলে দেওয়া হয় সময়। চালু হয় নতুন টাইম-জোন। 

ডিএসটি বা ‘ডেলাইট সেভিং টাইম’ (Daylight Saving Time) নামেই পরিচিত এই বিশেষ বন্দোবস্ত। আসলে, গ্রীষ্মের সময় সূর্যোদয়ের গড় সময়ের থেকে বেশ খানিকটা আগেই সূর্য ওঠে পূব-আকাশে। আবার শরতের পর থেকে গোটা শীতকাল জুড়ে সূর্য ওঠে দেরিতে। তাতে বিশেষত বিষুব রেখার থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে পৃথিবীর দুই মেরুর দিকে যেতে থাকলে, এই সময়ের ফারাক বাড়তে থাকে আরও। আর তার সমাধান হিসাবেই ডিএসটি-র জন্ম। 

আজ থেকে প্রায় ২৪০ বছর আগের কথা। মার্কিন পলিম্যাথ তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-জনক বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন সর্বপ্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই বিশেষ ব্যবস্থাটির। দূরদর্শী ফ্র্যাঙ্কলিন হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন, শুধুমাত্র গ্রীষ্মের দিনে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার জন্যই কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় রাষ্ট্র। কমে যায় দেশের উৎপাদনশীলতা। একইভাবে শীতে দ্রুত ঘুম থেকে ওঠার কারণে খরচ করা হয় বেশি মোমবাতি। সেই বাড়তি খরচকেও বহন করতে হয় যে-কোনো দেশের প্রশাসনকে। আর সেই কারণেই সূর্যোদয়ের সময়ের ওপর নির্ভর করেই, ঋতুমাফিক বদলে ফেলা উচিত কোনো দেশের টাইম জোন। 

গণিত, ব্যবহারিক প্রয়োগের উদাহরণ এবং কৌতুকে মোড়ে ফ্র্যাঙ্কলিনের এই প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পত্রিকা ‘দ্য জার্নাল অফ প্যারিস’-এ। যুক্তরাষ্ট্রেও সাড়া ফেলে দিয়েছিল বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের এই প্রস্তাব। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নীতি লাগু হতে সময় লেগে যায় প্রায় একশো বছর। ১৮৯৫ সাল। নিউজিল্যান্ডের জ্যোতির্বিদ জর্জ হাডসন ফের সরব হন ডিএসটি-র প্রচলন নিয়ে। তারপরই প্রথমে ব্রিটেন, পরে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় সময়ের বাঁচানোর এই আশ্চর্য কৌশল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতেও ব্যবহৃত হত ডিএসটি। অন্যদিকে ১৯৭০-এর দশকে জ্বালানি সমস্যা মেটাতে ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশও হাঁটে এই একই পথে। 

মজার বিষয় হল, আজ প্রযুক্তির যুগ। উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহৃত না হলেও নষ্ট হয় তা। ফলে দেখতে গেলে, আলো না জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ বাঁচানো হলে ব্যক্তিগত পরিসরে ইলেকট্রিক বিল কম হলেও, তাতে দেশের লাভ হয় না খুবটা। পাশাপাশি কৃষিকাজেও খুব একটা সাহায্য করে না এই বদলে দেওয়া সময়ের মাপকাঠি। তা সত্ত্বেও আজও গোটা বিশ্বেই বহু দেশে প্রচলিত এই রীতি। 

আগামী ১২ তারিখ মার্চ মাসের দ্বিতীয় রবিবার। আর এই বিশেষ দিনটিতেই যুক্তরাষ্ট্রে ১ ঘণ্টা এগিয়ে যাবে সময়। সেই উপলক্ষে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে সে-দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। পক্ষে-বিপক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন সে-দেশের তাবড় বুদ্ধিজীবীরা। অথচ, মজার বিষয় হল, ভৌগলিক দিক থেকে পূর্ব-পশ্চিম— ভারতের দুই প্রান্তের মধ্যে গাণিতিকভাবে সময়ের ব্যবধান প্রায় ২ ঘণ্টা হলেও, দিব্যি একটি টাইম জোন নিয়েই খুশি রয়েছে এ-দেশের মানুষ… 

Powered by Froala Editor