নেট-দুনিয়ায় কি আদৌ সুরক্ষিত ব্যক্তিগত পরিসর? প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ-বিতর্ক

বছরের শুরুতেই প্রাইভেসি পলিসিতে নতুন আপডেট নিয়ে হাজির বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ‘হোয়াটসঅ্যাপ’। আর বিতর্কের শুরু সেখান থেকেই। শুধুই বিতর্ক নয়, দানা বাঁধছে নানা ধরণের জল্পনাও। মার্ক জুকারবার্গের কড়া বার্তা, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী সমস্ত ব্যক্তিকেই তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য মাদার-কোম্পানি ফেসবুকের সঙ্গে ভাগ করতে হবে। অন্যথায় ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা আর এই মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করতে পারবেন না।

ঠিক কী ধরণের তথ্য ফেসবুকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হবে, সে-বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট কোনো বক্তব্য জানা যায়নি। আর এখান থেকেই শুরু হয়েছে জল্পনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এধরণের একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা সম্ভব। তার মধ্যেই ব্যক্তিগত যোগাযোগ নাম্বার, লাইভ ট্র্যাকিং, গ্রুপ; এসব তো থাকছেই। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপের সর্বশেষ সংযোজন ‘পেমেন্ট’ অপশনটি থেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক লেনদেনের হিসাবও জানতে পারে কোম্পানি। তাছাড়া মোবাইল ফোনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি জানা তো অসম্ভব নয়ই। এমনকি প্রশ্ন উঠছে হোয়াটসঅ্যাপের এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন পলিসি নিয়েও। এই পলিসির ফলে যেকোনো বার্তা তার প্রেরক এবং প্রাপক ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এই পলিসি কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আর এইসব জল্পনা সত্যি হলে বলতে হয়, সাধারণ মানুষের উপর বাণিজ্যিক সংস্থার নজরদারির এমন সুযোগ আর দ্বিতীয় কিছু হতে পারে না।

অবশ্য প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিতর্ক চলার পর জুকারবার্গের সুরও একটু নরম হয়েছে। সোমবার কোম্পানি বিজ্ঞপ্তি মারফত জানিয়েছে, কীধরণের তথ্য সংগ্রহ করা হবে না। আর সেই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সমস্ত ব্যক্তিগত মেসেজ, নিজস্ব গ্রুপ, ঠিকানা এবং সমস্ত মেসেজ ও কল লগের তথ্য সংরক্ষিতই থাকবে। তাহলে এভাবে দুটি আলাদা প্ল্যাটফর্মকে লিঙ্ক করার প্রকৃত কারণ কী, তা নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে এধরণের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনকে ব্যবহার করার ইতিহাস অবশ্য নতুন নয়। তবে নানা ধরণের সরকারি নিয়মের কারণে শেষ পর্যন্ত সেইসব পলিসিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে বাজারচলতি অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে। তবে এই বিষয়ে মার্ক জুকারবার্গের উপর ভরসা রাখতে রাজি নন অনেকেই। বিশেষ করে, গত এপ্রিলে একটি দীর্ঘ বিবৃতিতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম, এই তিনটি প্ল্যাটফর্মকে আলাদাভাবেই রাখা হবে। অথচ ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টগুলি লিঙ্ক করে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। আর এবার একইভাবে যুক্ত করা হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টগুলিকেও।

মূলত এর পিছনে বাণিজ্যিক মুনাফালাভকেই একমাত্র উদ্দেশ্য হিসাবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০০৯ সালে যখন হোয়াটসঅ্যাপ বাজারে আসে, তখন তার জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল এর অবাণিজ্যিক চেহারা। কোনো ধরণের অ্যাডভার্টাইজমেন্ট বা ব্যবসায়িক কোনোকিছুর প্রভাব ছিল না এতে। এরপর ২০১৪ সালে ফেসবুক কিনে নেয় এই মেসেজিং প্ল্যাটফর্মটি। আর এর পর থেকেই শুরু হয় নানা ধরণের পরিবর্তন। তবে হোয়াটসঅ্যাপের মূল কাঠামোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ তৈরি আজও সম্ভব হয়নি। এখন ফেসবুকের সূত্রে সমস্ত তথ্য যদি বাণিজ্যিক সংস্থার হাতের নাগালে এসে পড়ে, তাহলে নির্দিষ্ট ক্রেতাদের চিহ্নিত করে বিজ্ঞাপন পৌঁছে দেওয়া আর অসম্ভব হবে না। তবে আপাতভাবে এতে সাধারণ মানুষের সমস্যার কিছু না থাকলেও, বিশেষজ্ঞদের ধারণা সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে বিজ্ঞাপন পৌঁছে যেতে থাকলে তার মধ্যে নানা ধরণের গোপন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা এবং বিদ্বেষ ছড়ানোও অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যে আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে সরকারি তদন্ত কমিটি। আর সেইসঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। এর মধ্যেই বহু মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করে দিচ্ছেন। উল্টোদিকে ‘সিগন্যাল’ এবং ‘টেলিগ্রাম’ নামক মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে রেজিস্ট্রেশনের হিড়িক পড়ে গিয়েছে। তবে এই নেট-দুনিয়ায় আদৌ কতদিন মানুষের জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরগুলো সুরক্ষিত রাখা সম্ভব, সেই প্রশ্নই তুলে দিচ্ছে সাম্প্রতিক এই বিতর্ক।

আরও পড়ুন
হোয়াটসঅ্যাপ কলে ছাঁটাই ২০০০ কর্মী, অভিযোগ ইন্ডিবুলস-এর বিরুদ্ধে

Powered by Froala Editor