অমর চিত্রকথা পড়েছেন নিশ্চয়ই? ভারতের পৌরাণিক কাহিনি, রাজাদের গল্প এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই কমিক সিরিজ। তারই ৩০৩ নং ইস্যুতে একজন বিশেষ মানুষের কথা বলা হয়েছিল। ছোটখাটো, চশমা পরা, মোটা গোঁফের সেই মারাঠা মানুষটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ইতিহাসে তাঁর পরিচিতি ‘সেনাপতি বাপাত’ হিসেবে। তিনি, পাণ্ডুরং মহাদেব বাপাত।
১৮৮০ সালের নভেম্বরে মহারাষ্ট্রের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন বাপাত। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। পুনের ডেকান কলেজ থেকে পাশ করে বৃত্তি পেয়ে চলে যান এডিনবার্গের হেরিয়ট-ওয়াট কলেজে। তার আগে থেকেই অবশ্য বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ডেকান কলেজে পড়াকালীন বাপাতের সাথে পরিচয় হয় দামোদর বলওয়ন্ত ভিদের সাথে, যিনি ছিলেন মহারাষ্ট্রের অন্যতম বিপ্লবী সংগঠন চাপেকর ক্লাবের সদস্য। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য বাপাতকে উদ্বুদ্ধ করে দাদাভাই নৌরজি’র বিখ্যাত বই ‘Poverty of India’। সেখান থেকেই ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নির্মম অত্যাচারের ঘটনাগুলি সম্পর্কে তিনি অবহিত হন। বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ বিরোধী বক্তৃতা দিতে থাকেন। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে তাঁর বৃত্তি বাতিল করা হয়।
১৯০৭ সালে ভারতে ফিরে আসেন পাণ্ডুরং বাপাত। দেশে ফিরে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। বিনায়ক সাভারকারের নির্দেশে প্যারিস থেকে বোমা বাঁধার কৌশল শিখে আসেন। ১৯১২-তে বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলায় বাপাত অভিযুক্ত হিসেবে ধরা পড়েন। কিন্তু কোনরকম প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। ততদিনে বাপাতের চিন্তাজগতে এসে গেছেন মহাত্মা গান্ধী।
গান্ধীর আদর্শ মেনে শুরু হয় তাঁর বিপ্লবী জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। গান্ধীর দর্শন, সত্যাগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিও করেন। এই সময়ই একটি ঘটনা ঘটে যায় মহারাষ্ট্রে। পুনের কাছেই মুলা নদীর ওপর একটি বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করে টাটা কোম্পানি। কিন্তু কৃষকদের কোনরকম সম্মতি ছাড়াই সেই বাঁধের জন্য জমি নেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সেখানকার কৃষকরা। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পাণ্ডুরং ‘সেনাপতি’ বাপাত। সালটা ১৯২০-২১। শুরু হয় বিখ্যাত মুলশি সত্যাগ্রহ আন্দোলন। পৃথিবীর ইতিহাসে যা প্রথম অ্যান্টি ড্যাম মুভমেন্ট হিসেবে পরিচিত। তিন বছর ধরে এই অহিংস আন্দোলন চলার পর বাপাতকে গ্রেফতার করা হয়। যার পরবর্তীকাল থেকে শুরু হয় তাঁর বিপ্লবী জীবনের তৃতীয় পর্ব।
গান্ধীর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন সেনাপতি বাপাত। কিন্তু মুলশি সত্যাগ্রহের পর তাঁর মনে নানা প্রশ্ন আসতে শুরু করল। প্রশ্ন এল শুদ্ধ সত্যাগ্রহ নিয়ে, তার কার্যকারিতা নিয়ে। মহাত্মা গান্ধী এবং কংগ্রেসের বেশ কিছু নীতির সরাসরি সমালোচনা করলেন তিনি। ১৯৩১-এ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সুভাষচন্দ্র বসু’র সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সেই সময় সুভাষচন্দ্র বসু’র আহ্বানে মুম্বইয়ের এক জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন বাপাত। যেখানে তাঁকে তৃতীয়বার গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে সেই জনসভার রাস্তাটির নাম ‘সেনাপতি বাপাত রোড’।
১৯৬৭ সালের ২৮ নভেম্বর প্রয়াত হন বাপাত। তার আগে, এবং পরেও, স্বাধীন ভারত সরকার নানাভাবে সম্মানিত করে তাঁকে। স্বাধীনতার মুহূর্তে পুনেতে সর্বপ্রথম দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি। অমর চিত্রকথার পাশাপাশি, ১৯৭৭ সালে তাঁর নামে একটি পোস্টাল স্ট্যাম্পও ইস্যু করা হয়।