হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক। রাগান্বিত মুখ। তাঁর পিছনে তাঁকে আটকানোর জন্য ছুটছে টিনটিন আর স্নোয়ি। কমিক বইয়ের পাতাতেই এধরনের ছবি দেখে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু বহুতল বাড়ির আস্ত একটি দেওয়াল যদি সাজিয়ে তোলা হয় অতিপরিচিত কমিক চরিত্রদের নানান ছবিতে?
বেলজিয়ামের (Belgium) রাজধানী ব্রাসেলসে (Brussels) গেলেই দেখা মিলবে এমনই আশ্চর্য এক দৃশ্যের। ব্রাসেলসের বুকে আস্ত একটি রাস্তাই রয়েছে যা পরিচিত ‘দ্য কমিক বুক রুট’ (The Comic Book Route) নামে। ব্রাসেলসের লায়কেন এবং অডারগেম অঞ্চলের সংযোগকারী এই রাস্তায় প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালেই দেখা যায় প্রকাণ্ড সব ম্যুরাল। সে-সব দেওয়ালচিত্রে কখনও জায়গা করে নেয় টিনটিন, স্মার্ফ, অ্যাস্টেরিক্স, কখনও আবার দেখা মেলে লাকি লিউক, গ্যাস্টন, জিল জর্ডন, মিকি মাউসের। হঠাৎ যেন এসে পড়েছেন এক স্বপ্নরাজ্যে, একবার এই রাস্তায় ঢুকে পড়লে যে-কারোর মনে হবে এমনটাই। কিন্তু কে তৈরি করল এইসমস্ত ম্যুরাল?
সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আসলে বেলজিয়ামকে কমিক্সের রাজধানী বলা হলেও ভুল হয় না এতটুকু। বলতে গেলে, আনুষ্ঠানিকভাবে না-হলেও, কমিক্সকে জাতীয় শিল্পের মর্যাদা দিয়েছে সে-দেশের সরকার। বেলজিয়ামে সবমিলিয়ে কমিক আঁকিয়ের সংখ্যা প্রায় ৭০০-রও বেশি। তাছাড়াও বেলজিয়ামে রয়েছেন সহস্রাধিক কমিক স্ট্রিপ লেখক। সবমিলিয়ে সে-দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার পিছু কমিক শিল্পীর সংখ্যা যে-কোনো দেশের থেকেই বেশি। এমনকি কমিক্সের প্রতি ভালোবাসা থেকেই অধিকাংশ মানুষই শৈশব বা কৈশোরে আঁকার স্কুলে ভর্তি হন বেলজিয়ামে। বেলজিয়ামের পথে পথে ঘুরলে বহু দোকান, পানশালা, বাড়ি, এমনকি জাদুঘরেও দেখা মিলবে কমিক্সের। বহু রাস্তায় দেখা যাবে কমিক চরিত্রদের মূর্তিরও।
১৯৯১ সাল। বেলজিয়ান নাগরিকদের এই কমিকপ্রীতিকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বিশেষ প্রকল্প চালু করে বেলজিয়াম সরকার। সিদ্ধান্ত নেয়, বেলজিয়ামের একটি আস্ত রাস্তাকে সাজিয়ে তোলা হবে কমিক চরিত্রদের ছবিতে। বেলজিয়ামের দীর্ঘ ইতিহাস ও কমিক স্ট্রিপের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে জনসমক্ষে তুলে আনতেই একটি বিশেষ উদ্যোগ। সরকারের পাশাপাশি এই প্রকল্পের অংশ হয়ে ওঠে বেলজিয়ান কমিক স্ট্রিপ সেন্টার। সরকার পুঁজি জোগালেও, এই সংস্থার শিল্পীরাই মূলত তুলির ছোঁয়ায় বাস্তবায়িত করেছিলেন প্রকল্পটিকে।
তবে মজার বিষয় হল, কমিক্স বা কার্টুনের জন্মস্থান বেলজিয়াম নয়। এমনকি বিশ শতকের গোড়ার দিকেও সেভাবে কমিক্স বা কার্টুন জনপ্রিয় ছিল না বেলজিয়ামে। ততদিনে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের মতো দেশে রীতিমতো ডানা মেলেছে কমিক্স ও কার্টুন। বরং, বেলজিয়ামে এই কমিকপ্রীতির নেপথ্যে রয়েছে ফরাসি প্রভাব। ১৯০০-র দশকে ফ্রান্সে প্রকাশিত হতে শুরু করে বেকাসিন এবং লেস পিডস নিকেলস নামের দুটি কমিক্স। সেগুলিই মূলত রপ্তানি করা হত বেলজিয়ামে। এই কমিক্সগুলি প্রাথমিকভাবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাড়া ফেলে দিলে, বিভিন্ন বেলজিন দৈনিক ছোটো ছোটো কার্টুন ও কমিক্স স্ট্রিপ ছাপা শুরু করে। বেলজিয়ামে পূর্ণাঙ্গভাবে কমিক্সের উৎপাদন শুরু হয় এরও বছর পনেরো পরে। ১৯২০-র দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। বেলজিয়াম জোনেল্যান্ড, পেটিটস বেলজেসের মতো জনপ্রিয় যুবপত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে শুধুমাত্র কমিক্সের ওপর ভর করেই।
এই নবতরঙ্গের হাত ধরেই ১৯২৯ সালে জন্ম নেয় টিনটিন। নেপথ্যে বেলজিয়ান কমিক্স আর্টিস্ট জর্জেস প্রসপার রেমি। যাঁকে আমরা চিনি হার্জ নামে। ১৯৩৪ সালে পল উইঙ্কলার নামের আরও এক বেলজিয়ান কমিক প্রকাশক চুক্তি করে ডিজনির সঙ্গে। মিকি মাউস তো বটেই, পাশাপাশি আমেরিকার বিভিন্ন কমিক চরিত্রদের নিয়ে সিরিজ প্রকাশিত হতে শুরু করে বিভিন্ন বেলজিয়ান পত্রপত্রিকায়। চালু হয় কিংবদন্তি কমিক্স পত্রিকা ‘স্পাইরু’-ও।
কমিক্স উৎপাদনের এই ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা ইউরোপ রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায়, আমেরিকা থেকে কমিক্স আমদানি করা অসম্ভব হয়ে ওঠে বেলজিয়ামে। ফলে সাধারণ মানুষের কমিক্স-খিদে মেটানোই দায় হয়ে উঠেছিল বেলজিয়ামে। এই ঘটনাই পরোক্ষভাবে পরিপক্ক করে তোলে বেলজিয়ান কমিক্স বাজারকে। গোটা দেশে জন্ম নেয় কয়েক ডজন কমিক্স প্রকাশনা সংস্থা। তৈরি হয় অসংখ্য কমিক চরিত্র। এমনকি ’৫০ এবং ’৬০-এর দশকে বিশেষভাবে কমিক্স, কার্টুন ও ক্যারিকেচার শিখতেন বেলজিয়ামের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীই।
এরপর আর কমিক্সের জন্য পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বেলজিয়ামকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপারহিরো কমিক্সের বিপরীতে স্মার্ফ, অ্যাসটেরিক্স, টিনটিন, লাকি লিউকরাই হয়ে উঠেছিল বেলজিয়ামের গর্বের প্রতীক। বেলজিয়াম তো বটেই, ইউরোপের গণ্ডি পেরিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। অনূদিত হয় অজস্র ভাষায়।
বেলজিয়ামের এই বর্ণময় কমিক্স ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতেই ১৯৯১ সালে বিশেষভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল ‘দ্য কমিক বুক রুট’। বহু বহুতল বাড়ির গোটা দেওয়াল-জুড়ে ছবি আঁকার জন্য গেঁথে ফেলা হয়েছিল সমস্ত জানলা দরজা। কোথাও আবার ভেঙে ফেলা হয় আস্ত ঝুল-বারান্দা। সাধারণ মানুষ বিন্দুমাত্র আপত্তিও করেননি তাতে। আজ বেলজিয়ামের এই পথে গেলে দেখা মিলবে সবমিলিয়ে প্রায় ৫০টিরও বেশি প্রকাণ্ড ম্যুরাল। আর তাদের সৌজন্যেই বেলজিয়ামের এই পথ আজ হয়ে উঠেছে সে-দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
Powered by Froala Editor