'পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হবে?' বাঙালি চিত্রপরিচালক থেকে শুরু করে সাহিত্যিক; প্রায় সকলেই তাঁদের কোনো-না-কোনো কাজের মাধ্যমে দুর্গোৎসবকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সবগুলির মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে শীর্ষে থাকবে প্রথম লাইনটি। সত্যজিতের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ (Joy Baba Felunath) পুজোর সময় কাশী বেড়াতে গিয়ে ঘোষাল বাড়ির গণেশ চুরির রহস্যের কিনারা করতে নেমে পড়েন ফেলুদা। ঘোষাল বাড়ির ঠাকুর (Durga Idol) গড়ছিলেন শশীবাবু। তাঁকেই ফেলুদা (Feluda) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হবে? জবাবে শশীবাবু বলেছিলেন 'হ্যাঁ হ্যাঁ তা হয়ে যাবে'। পাটিগণিত বলে, এই কথাবার্তা হয়েছে চতুর্থীর দিন। প্রতি বছর চতুর্থীতে সমাজ মাধ্যমজুড়ে এই দৃশ্যের ছবি, ভিডিওর প্লাবন শুরু হয়। মিমের বন্যা বয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু যাঁর উত্তরে বাঙালির ষষ্ঠী আসে, সেই গণেশ মহল্লার শশীবাবুকে কি চেনে আজকের প্রজন্ম?
সত্যজিৎ বহু অখ্যাত মানুষকে নিজের ছবিতে ব্যবহার করেছেন, প্রত্যেকেই মানিকের কল্যাণে মানিক্য হয়ে উঠেছেন। তবে শশীবাবু কিন্তু প্রথম থেকেই ছিলেন জেম! তাঁর নাম সন্তোষ সিংহ, এক দিকপাল মঞ্চ অভিনেতা। কিন্তু ওই যে, শিশিরবিন্দুটাই দেখা হয় না আমাদের, সেই কারণেই অচেনা থেকে যান সন্তোষবাবুরা। শতাধিক সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘জিঘাংসা’, ‘অভয়ের বিয়ে’র মতো সিনেমা রয়েছে তাঁর চলচ্চিত্রাভিনেতা জীবনে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগে প্রায় ১২ বছর পড়িয়েছেন। থিয়েটারের দুনিয়াতে তিনি ছিলেন স্বপ্রতিভ। ১৯২৫ সালে স্টার থিয়েটারে পা রেখেছিলেন সন্তোষ সিংহ। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রটি আরোগ্য নিকেতন, চিরকুমার সভার মতো নাটকে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। স্টার, মিনার্ভা, রঙমহল তিনটিই আলোকিত হয়েছে সন্তোষ সিংহের দীপ্তিতে। নিজেও দুটি নাটকের দল খুলেছিলেন, যদিও সে-দুটি তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৬৫ সালে বিশ্বরূপায় শেষবারের মতো মঞ্চে নেমেছিলেন সন্তোষ সিংহ।
তবে সন্তোষ সিংহের কাছে বাংলা সিনেমা আরও এক কারণে কৃতজ্ঞ। অরুণ থেকে উত্তমের উত্তরণের যাত্রায় অনুঘটক ছিলেন এই মানুষটি। উল্টোরথের রবি বসুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং মহানায়কই বলেছিলেন সে-কথা। উত্তমকে হাতে ধরে মুখের অভিব্যক্তি শিখিয়েছিলেন সন্তোষ সিংহ। সেই অর্থে তিনিই গুরুর গুরু। অরুণ তখনও উত্তমকুমার হয়ে ওঠেনি, সেই সময় এম.পি.পিকচার্সে, মহানায়ক সন্তোষ সিংহকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁকে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে ব্যবহার করা হত বলেও উত্তমেরও ইন্ডাস্ট্রির প্রতি অনুযোগ ছিল। প্রায় ছাপান্ন রকমের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান আর অসাধারণ ভয়েস মডিলিউশনের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সন্তোষবাবু।
আজ সেই সন্তোষবাবুই সত্যজিতের ছবির দৃশ্যের মাধ্যমে আমাদের নিউজ ফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে আজ ষষ্ঠীর দিনে আরেকটা মজার তথ্য দিয়ে যাই, রিলে ঘোষল বাড়ির ঠাকুর গড়ছিলেন সন্তোষ সিংহ, আর রিয়েল লাইফে ওই ঠাকুর গড়েছিলেন কে? নাম শুনলে খানিক ধাক্কা লাগতে পারে! ওই প্রতিমার কারিগর ছিলেন গণেশ মহল্লার পটুয়া ফেলু। প্রদোষ মিত্তিরের ভাষায়, টেলিপ্যাথি...
Powered by Froala Editor