লুসিবাবুর স্মৃতি আর বিশ্বযুদ্ধের প্রতিপত্তি নিয়ে আজও জনপ্রিয় উত্তরপাড়ার প্রাচীনতম রেস্টুরেন্ট

“আমাদের আদি বাড়ি ছিল বেনারসে। পরিবারের সঙ্গে কোনো কারণে মতানৈক্যের কারণে বাবা চলে আসেন এখানে। তারপর নানা জায়গায় ঘুরেছেন জীবিকার সন্ধানে। অবশেষে উত্তরপাড়ার জমিদার মাখন মুখার্জি জায়গাটা দিয়েছিলেন দোকান তৈরির জন্য। সেই শুরু।” লুসিবাবুর রেস্টুরেন্টের বর্তমান কর্ণধার সঞ্জয় মুখার্জি শোনাচ্ছিলেন জন্মকথা। সঠিক সময় তাঁরও জানা নেই। তবে বিশের দশকের শেষেই উত্তরপাড়া গ্রন্থাগারের উল্টোদিকে তৈরি হয় এই রেস্টুরেন্ট। উত্তরপাড়া শহরের সবচেয়ে পুরনো রেস্টুরেন্ট। অর্থাৎ বয়স ১০০ বছর ছুঁতে চলল।

আজ থেকে ১০০ বছর আগে কলকাতা শহরেও রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সেখানে মফঃস্বল শহরে রেস্টুরেন্ট তৈরির পরকল্পনা সত্যিই অবাক করে। সঞ্জয় মুখার্জি শোনাচ্ছিলেন অনুপ্রেরণার কথাও। “উত্তরপাড়া বাজারে তখন নানা জায়গা থেকে সবজির পসরা নিয়ে আসতেন বিক্রেতারা। তাঁরা সঙ্গে করে খাবার নিয়ে আসতেন। কারোর সঙ্গে থাকত মুড়ি, কেউ রুটি নিয়ে আসতেন। দুপুরের গরম খাবার তাঁদের কাছে ছিল স্বপ্ন। আর সেটাই সত্যি করে তুলতে চেয়েছিলেন বাবা।” এভাবেই ত্রিদিব মুখার্জি ওরফে লুসিবাবুর হাতে গড়ে উঠেছিল একটি রেস্টুরেন্ট। তখন অবশ্য কোনো নাম ছিল না। তবে এর মধ্যেই এসে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। উত্তরপাড়া গ্রন্থাগারে গড়ে উঠল সেনাছাউনি। আর তাঁরা হয়ে উঠলেন রেস্টুরেন্টের নতুন খরিদ্দার। প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করল। নতুন নাম পেল রেস্টুরেন্ট। ‘বান্ধব রেস্টুরেন্ট’। তবে সেই নাম বেশিদিন টিকল না। ইতিমধ্যে লুসিবাবুর রেস্টুরেন্ট নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দোকান। সঞ্জয় মুখার্জি এবং শম্ভুনাথ বসু তৈরি করলেন নতুন সাইনবোর্ড।

শম্ভুনাথ বসু ত্রিদিব মুখার্জির নিজের ছেলে না হলেও ছিলেন তার থেকে বেশি। সঞ্জয় মুখার্জির কাছেও তিনি ‘বড়দা’। এই দোকানকে এতদিন আগলে রেখেছেন তিনিই। তবে বার্ধক্যজনিত কারণে এখন আর দোকানে আসতে পারেন না। সঞ্জয় বাবুও সেভাবে সময় দিতে পারেন না। এখন দোকানকে আগলে রেখেছেন সবচেয়ে পুরনো কর্মচারী অশোক সাউ। যোগাযোগের জন্যও তাঁরই নাম দেওয়া। তবে চাহিদা ক্রমশ কমছে। স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন অশোকবাবু। এর মধ্যে করোনা মহামারীর কারণে ৬ মাস বন্ধ ছিল দোকান। ‘পুজোর ঠিক আগে আবার দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু মানুষের আনাগোনা এখন হাতেগোনা।” বলছিলেন অশোকবাবু। তাছাড়া সঞ্জয়বাবুর কথায়, “একসময় ব্যান্ডেল থেকেও মানুষ কষা মাংস, কাটলেটের আকর্ষণে আসতেন এখানে। এখন তো সব জায়গাতেই ফাস্টফুডের দোকান গজিয়ে উঠেছে। সেই চাহিদা আর নেই।”

আরও পড়ুন
কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোয় ভোগ পান অসুরও; ৪০০ বছরেও বদলায়নি সেই রীতি

আরও পড়ুন
ভারতেই রয়েছে পৃথিবীর প্রাচীনতম সাইক্লোট্রন, বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘেঁটে তৈরি হল তথ্যচিত্র

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষের খাদ্যাভ্যাসও। কিন্তু তার ছাপ পড়েনি লুসিবাবুর রেস্টুরেন্টের মেনুতে। আজও তার রান্নার পদ্ধতি বাণিজ্যিক হয়ে ওঠেনি। “ঘরের রান্নার স্বাদই তো আমাদের ঐতিহ্য। সেখান থেকে সরে আসতে পারব না।” বলছিলেন সঞ্জয়বাবু। আজও এখানে রান্নার পদ্ধতি একেবারে আলাদা। বিক্রি কম হলে পরেরদিন বাসি খাবার দেওয়ার পদ্ধতি আজও শিখে উঠতে পারেনি লুসিবাবুর দোকান। সময়ের ছাপ সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আজও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে লুসিবাবুর রেস্টুরেন্ট। ১০০ বছরের অর্থনীতির পরিবর্তন যেন থমকে গিয়েছে চার দেয়ালে ঘেরা ছোট্ট দোকানে।

আরও পড়ুন
চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর

Powered by Froala Editor

More From Author See More