আজও ইয়েসুদাসের গান দিয়েই বন্ধ হয় শবরীমালার দরজা

১৯৯৯ সাল। শেষ হচ্ছে আরও একটি শতাব্দী। কত কি ঘটে গেছে এই একশো বছরে। দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলেছি আমরা, দেখেছি পরাধীনতা, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু। নতুন শতাব্দী যেন আলো, আশা আর শান্তি নিয়ে আসে, সেজন্যই প্যারিসের বুকে বসেছে সঙ্গীতের আসর। কনসার্টের নাম ‘মিউজিক ফর পিস’। লিওনেল রিচি, রে চার্লস, জুবিন মেহতা’র মতো সঙ্গীত প্রতিভারা উপস্থিত হয়েছেন সেই মঞ্চে। এসেছেন আরও একজন ভারতীয়ও। বছর ষাটেকের সেই দক্ষিণী প্রৌঢ়ের হাতেই ইউনেস্কো তুলে দিল বিশেষ সম্মান। প্যারিসের মঞ্চে মাথা পেতে সেই সম্মান গ্রহণ করলেন কে জে ইয়েসুদাস… 

তিনি ‘গণগন্ধর্বন’। তাঁর গলা যেন ভগবানের দরজায় পৌঁছে যায় প্রতিবার। ইয়েসুদাসের সঙ্গীতের জীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল ছোটো থেকেই। মধ্যবিত্ত খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম; অর্থ সেরকম না থাকলেও সঙ্গীত ছিল ভরপুর। বাবা ছিলেন মালয়ালম ধ্রুপদী সঙ্গীতের সাধক। সাত সুরের আলো তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন ইয়েসুদাস। পরবর্তীকালে অবশ্য কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে অধ্যায়ন করেন। ভক্তি, সাধনা, নিষ্ঠা আর রেওয়াজ— আজও এই সবকিছু অক্ষুণ্ণ রেখেছেন ইয়েসুদাস। ষাটের দশকের শেষ লগ্ন থেকে দক্ষিণের সিনেজগতও পরশ পেল এমন বিরল প্রতিভার। 

দক্ষিণী ভাষা থেকে হিন্দি, বাংলা, অসমিয়া, পাঞ্জাবী— ভারতের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়েছেন কে জে ইয়েসুদাস। আর তাঁর সংখ্যা কত জানেন? ৮০ হাজারেরও বেশি! একটি জীবনে এতগুলো গান আর কেউ গেয়েছেন কি! শুধু দক্ষিণেই নয়, বলিউডের ময়দানেও রাজত্ব করেছেন ইয়েসুদাস। সত্তর দশকে এসে মুম্বইয়ের ফিল্মি দুনিয়ায় প্রবেশ করেন তিনি। ততদিনে অবশ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন তিনি। শুরুর দিন থেকেই নিজের চিহ্ন রেখেছেন তিনি। মনে পড়ে ১৯৭৬-এ মুক্তি পাওয়া ‘ছোটি সি বাত’ সিনেমাটি? এবং সেই সিনেমারই গান ‘জানেমন জানেমন’? সলিল চৌধুরীর সুরে বিখ্যাত এই গানটি ইয়েসুদাসের গলাতেই পূর্ণতা পেয়েছিল। 

ওই বছরেই মুক্তি পেল ‘চিতচোর’। বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত এই সিনেমার সেই অমর গান ‘গোরি তেরা গাঁও বড়া প্যায়ারা’। এখানেও জারি রইল কে জে ইয়েসুদাসের জাদু। সেই জাদু আজও অমলিন। এই সিনেমারই সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্র জৈন। চোখে দেখতে পেতেন না এই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীত পরিচালক। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যদি কখনও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে, তাহলে কাকে প্রথম দেখতে চান? পরিবার, বাকি গায়ক-গায়িকা, শিল্পীদের বাদ দিয়ে রবীন্দ্র জৈনের মুখে একটাই নাম ভেসে এসেছিল— ইয়েসুদাস! 

নয়তো এ আর রহমান, বাপ্পি লাহিড়ীর মতো তাবড় সঙ্গীত পরিচালক তাঁকে ভগবান বলে মনে করতেন না। তাঁর গলা, সুর, সাধনা যেন স্বয়ং সরস্বতীর ঘর থেকে আসা। কী অবলীলায় সুরের সঙ্গে ভাব, লয় মিশিয়ে দিতে পারেন তিনি! এতটুকুও বাহুল্য মনে হয় না। ভারতের  সঙ্গীত জগতে ইয়েসুদাসের প্রভাব কতটা তা বোঝাতে একটা উদাহরণ দেওয়াই যায়। জি দেবরঞ্জনের সুরে তিনি গেয়েছিলেন ‘হরিবরসনম’ গানটি। মূলত ভক্তিমূলক এই সঙ্গীতটি সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এমন জায়গায় চলে যায় যে, খোদ শবরীমালা মন্দির প্রাঙ্গণেই বেজে ওঠে এই গানটি। আজও প্রত্যেকদিন মন্দির বন্ধের আগে ইয়েসুদাসের এই গানটি চালানো হয় শবরীমালায়। 

শুধু তাই নয়, ইয়েসুদাসের জন্মদিন আজ রীতিমতো উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে। মন্দিরে সরস্বতীর আরাধনা করে জন্মদিন শুরু করেন তিনি। আরাধনা বলতে কোনো মন্ত্র-তন্ত্র নয়; স্রেফ গান। শুদ্ধ, পবিত্র সুরই দেবতার অর্ঘ্য হয়ে ওঠে। যখন কথা বলেন, তখন অত্যন্ত সাধারণ তিনি। কিন্তু তানপুরার তান শুরু হলেই বদলে যায় পরিবেশ। কে জে ইয়েসুদাস হয়ে ওঠেন সিদ্ধপুরুষ… 

আরও পড়ুন
বড়োদিনের গানেই বাজিমাত, আজও সর্বাধিক বিক্রিত সিঙ্গেল বিং ক্রসবির ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’

তথ্যসূত্র
১) ‘কেরিয়ারে ৮০ হাজার গান! মেয়েদের পোশাক নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন কিংবদন্তি গায়ক যেশুদাস’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘KJ Yesudas: A name that spells melody’, Saraswathy Nagarjan, Athira M, K Pradeep, The Hindu
৩) ‘80,000 Songs, Many Languages, 60 Years: Here is Why KJ Yesudas is Known as ‘Celestial Singer’’, Rinchen Norbu Wangchuk, The Better India 

Powered by Froala Editor

More From Author See More