“প্রথম প্রথম অনেকের কাছ থেকেই তির্যক কথা শুনতে হয়েছে। অনেকে ভেবেছিলেন সত্যিই আমরা এমন একটা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারব কিনা। শিক্ষিত হয়েই এমন একটা কাজ করলে মান-সম্মান নষ্ট হবে, সে কথাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু আমরা কোনোদিনই সেসব ভাবিনি। আমরা ভেবেছিলেন একদম নতুন কিছু একটা করব।”
বলছিলেন দেবজ্যোতি সাহা। অবশ্য স্থানীয়দের কাছে এখন তিনি পরিচিত ‘ফুচকাওয়ালা’ নামেই। দেবজ্যোতি এবং তাঁর বোন জ্যোতির্ময়ী মিলেই খুলে ফেলেছেন আস্ত এক ফুচকার দোকান। তবে প্রথাগত ফুচকার স্টলের থেকে স্বাদে, ভাবে, আমেজে— সবেতেই একেবারে ভিন্ন এই উদ্যোগ। আর তা হবে নাই বা কেন? তাতে যে মিশে আছে দিনবদলের স্বপ্ন।
জ্যোতির্ময়ী এবং দেবজ্যোতি উত্তর ২৪ পরগণার খড়দার বাসিন্দা। দুই ভাই-বোনই ইঞ্জিনিয়ার। দেবজ্যোতি চাকরিও করতেন একটি কর্পোরেট কোম্পানিতে। অন্যদিকে জ্যোতির্ময়ী এখনও পাঠ্যরত বিটেকে। বিষয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। দাদার পথে হেঁটে, বড়ো কোনো সংস্থায় কাজ করাই ছিল তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু গোটা পরিস্থিতিটাকেই যেন হঠাৎ ওলোটপালট করে দিল করোনাভাইরাস মহামারী।
আরও পড়ুন
বিক্রি তলানিতে, তবু পুতুল শিল্পকে আঁকড়েই দিনবদলের অপেক্ষায় নতুনগ্রাম
সেসময় দেবজ্যোতির অফিস থেকে সোজা-সাপটা জানিয়ে দিয়েছিল, টিকে থাকতে গেলে প্রায় অর্ধেক বেতনে কাজ করতে হবে। সংসারের খরচ, বাবা-মায়ের চিকিৎসা, বোনের পড়াশোনার খরচ তো রয়েইছে। তার ওপরে বাবার মুদিখানার দোকানও বন্ধ হয়ে পড়ে আছে কমপক্ষে দশ বছর। এই সীমিত উপার্জন দিয়ে তো একটা গোটা পরিবার চলতে পারে না! তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ছিল যত্নে সাজানো স্বপ্নগুলো। দমবন্ধ হয়ে আসা পরিস্থিতিতেই তাই বিকল্পের সন্ধান শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বাবার পুরনো দোকানেই গড়ে ওঠে ‘ফুচকাওয়ালা’-র অভিনব স্টল।
আরও পড়ুন
দিনবদলের স্বপ্ন দেওয়ালজুড়ে, তৌসিফ হকের ছবিতেই ভাষা পাচ্ছে বাম ইস্তেহার
উচ্চশিক্ষিত হয়েও দুই ভাই-বোনের এমন এক পথচলাকে ভালো চোখে দেখেনি প্রতিবেশীরা। কিন্তু সাহস যুগিয়ে গেছেন পরিবারের বড়োরা। কমতি ছিল না বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায়। গত বছরের অক্টোবর মাসে শুরু হয়েছিল ‘ফুচকাওয়ালা’-র পথ চলা। আর এই মাস আটেকের জার্নিই বদলে দিয়েছে গোটা ছবিটাকে। এখন খড়দার এই দোকানই স্থানীয়দের কাছে রীতিমতো সেনসেশন।
আরও পড়ুন
পরিবারের সামনেই ধর্ষিত হন দলিত মেয়েরা; দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে বিহারে লড়াই স্মিতার
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা বিক্রি করার প্ল্যান আমাদের কোনোদিনই ছিল না। হঠাৎ করেই যে এই পথ বেছে নেওয়া তেমনটাও না। আমরা অভিনব কিছু করতে চাইছিলাম। নিজেরা বাড়িতে বসে সেইসময় অনেক কিছু ট্রাই করি। ট্রায়াল এন্ড এররের মাধ্যমে বহু এক্সপেরিমেন্ট করেছি। তারপর এই সিদ্ধান্ত”, জানালেন জ্যোতির্ময়ী সাহা।
তবে তাঁদের অভিনবত্ব শুধু দোকানে সজ্জা কিংবা ব্যবস্থাপনাতেই নয়। ‘ফুচকাওয়ালা’-র মেনু দেখলেও রীতিমতো আশ্চর্য হতেই হয়। কী নেই সেখানে? সাধারণ ফুচকা তো রয়েইছে। শুরুতে সাতটি আইটেম নিয়েই শুরু হয়েছিল উদ্যোগ। তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশি ফুচকা, চিকেন ফুচকা, আইসক্রিম ফুচকা, চকোলেট ফুচকা, দুই ফুচকা। পরে আরও লম্বা হয় দোকানের তালিকা। চিংড়ি, খাট্টামিঠা ফুচকাও যুক্ত হয়েছে মেনুকার্ডে। জুড়েছে বেশ কয়েকরকম স্যান্ডউইচ, চকোলেট শেক। আগামীতেও আরও নতুনত্ব পদের এই সংযোজন যে অব্যাহত থাকবে, তারই ইঙ্গিত দিলেন উদ্যোক্তারা।
তবে এই উদ্যোগে শুধু তাঁদের জীবনই পাল্টে গেছে এমনটা নয়। দোকানে ইতিমধ্যেই দুই তরুণ কর্মচারীকে নিয়োগ করছেন তাঁরা। ফলত, লকডাউনের এই কঠিন পরিস্থিতিতে সামান্য হলেও, বেকারত্বের সমাধান দিচ্ছে এই উদ্যোগ। অন্যদিকে এই ব্যবসার মাঝে থেমে নেই দুই ভাইবোনের প্রথাগত লড়াই। দোকান সামলেই অফিসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন দেবজ্যোতি। অন্যদিকে জ্যোতির্ময়ীও চালিয়ে যাচ্ছেন পঠনপাঠন। লক্ষ্য অপরিবর্তিত। সফল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। তবে এই স্টলের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে নারাজ দু’জনেই। অবস্থার বদল হলেও, এই দোকান যে বন্ধ হবে না— সেকথাই জানিয়ে দিলেন সহোদর-সহোদরা। এই লড়াই যে একদিন স্বপ্নে উড়ানে বদলে যাবে, তাতে সন্ধেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor