এই শহরে ঢোকার রাস্তা অনেক। বেরনোর রাস্তা নেই। যাঁরা আসেন, কোনো এক মায়ায় তাঁরা আটকে যান। তাঁদেরই একজন রামপ্রবেশ মাজি। এক ফুচকাওয়ালার সহকারী। বয়স মাত্র ১৬ বছর।
গুরুয়া নদীর পার ধরে সাইকেলের টায়ারটাকে ছোটো একটা কাঠিয়ে দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেত ছোট্ট রামপ্রবেশ, তার কথায় রামপরবেশ। চার ভাই দুই বোনের মেজো সে। মোরহার নদীর একটা শাখা গয়া জেলায় তাদের গ্রাম সালেমপুর এসে নাম নিয়েছে গুরুয়া। স্কুলফেরত রোজই সে চলে যেত নদীর পারে। ‘চল মেরা ঢাসু গাড়ুম জোর সে চল’ – বলেই সে নিজের আর টায়ারের ছোটার গতি বাড়াত। দু-চোখে স্বপ্ন—পড়াই-লিখাই করে একদিন সে সিনেমার মিঠুনের মতো বড়ো গাড়ি চড়বে। বাবা উদয় মাজির মতো রিকশা চালাবে না। দু-চোখে সেই স্বপ্ন নিয়ে রোজ চলে যেত নদীর পারে টায়ার ছোটাতে। বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রামপ্রবেশের বুক থেকে। দু-মাস হলো তার ঠিকানা দমদমের প্রাইভেট রোডের ঘুপচি ঘর। এখন সে গ্রামতুতো চাচা অরবিন্দ সাউয়ের ফুচকার হেল্পার। প্রতি সন্ধ্যায় মতিঝিল মোড়ের গেটে ফুচকার গাড়ি নিয়ে বসে।
কলকাতায় কেন এসেছ?
হালত কে মারে ভাইয়ার। বড়ো দাদার বিয়ে হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অসুখ, বাড়ির বেহাল অবস্থা, বাবার রিকশায় রোজগারের নিরাপত্তহীনতা - সবমিলিয়ে ‘মঝলা’ বেটা হোনে কে কারণ ঘর কা বোঝ মুঝে হি উঠানা পড়া।
স্কুলে নাম কাটা গেল। গ্রামেই এক ঠিকাদারের কাছে পাথর ভাঙার কাজ করি কিছুদিন, তারপর গাঁয়েরই বিনয় পাসোয়ানের হাত ধরে সুরাটে চলে যাই কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির কাজে।
বয়স কত তখন? কোন ক্লাসে পড়তে?
সকুল (হিন্দিতে বিশেষ করে বিহারের দেহাতি হিন্দিতে স্কুলকে এভাবেই বলা হয়) মে পাঁচবি অর্থাৎ ফাইভ পাশ করেছি সবে মাত্র। জানতে হো সেকেন্ড হুয়া থা সকুল মে, লেকিন পড়া ছেড়ে দিতে হল। এগারো বারো বছর বয়েস তখন।
কেমন ছিল মনের অবস্থা?
ভালো ছিল না দাদা। প্রথম প্রথম কান্না পেত, কিন্তু কী করব। দাদা, বাবা দু-জনেই অসুস্থ। ঘরের খরচ চলবে কী করে! ফ্যাক্টরিতে মন লাগত না, মনে হত পালিয়ে যাই। বন্ধুদের কথা মনে পড়ত, গুরুয়া নদীর কথা মনে পড়ত। তারপর একসময় সব সয়ে গেল।
সুরাট থেকে কলকাতা এলে কেন?
ওখানকার ফ্যাক্টরিটা বন্ধ হয়ে গেল। চলে এলাম কলকাতা। অরবিন্দ চাচা কিছু টাকা ধার দিয়েছিল বাবাকে। চাচা বলল—আমার সঙ্গে চল, কাজ শেখ, তারপর কলকাতায় বা গাঁয়েই নিজের ব্যাবসা চালু করতে পারবি।
কলকাতা না সুরাট কোনটা ভালো?
সুরাট। কেননা ওখানে সকাল দশটায় ফ্যাক্টরি শুরু, সন্ধ্যে ৭টায় ছুটি। ফলে টাইম মিলত প্রচুর। তখন হলে সিনেমা দেখা যেত। এখানে তো সকাল থেকেই কাজ। বাজারে যাওয়া, ফুচকা বানানো, তারপর সন্ধ্যেবেলা ফুচকার ঠেলা নিয়ে মার্কেটে বসা, চলবে সেই রাত ১১টা অবধি। রবিবারেও ছুটি নেই। সময় কোথায় সিনেমা দেখার। তবে ইঁহা কা আদমি লোগ আচ্ছা হ্যায়। বেওহার আচ্ছা হ্যায় লেড়কি আউর জেনানা লোগোন কি। লেকিন সুরাট মে আইসান নেহি হ্যায়।
কেমন লাগছে কলকাতা?
সবে এসেছি ভাইয়া। বাড়িতেও অবস্থা খুব খারাপ। আমরা ভুমিহার লোক, নিজেদের খেতিবাড়ি নেই। খারাপ-ভালোর বিচার করার আমরা কে? লেকিন আভি থোড়া থোড়া আচ্ছা লাগ রহা হ্যায়। আগে ভগবান মালিক।
কলকাতায় থেকে যাবে?
সেসব তো দাদা ভগবানের উপর নির্ভর করছে। আগে ভালো করে কাজ শিখি, তারপর যদি কলকাতায় থাকি তাহলে এখানেই ফুচকার ঠেলা লাগাব। ভগবান মুখ তুলে চাইলে পরে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে বেওসা করব নয়তো ফুচকার ঠেলা লাগাব।
বলতে বলতে মালিকের ডাকে সে ছুটে যায় খরিদ্দার সামলাতে। মিঠুন চক্রবর্তীর ভক্তের ইচ্ছা, ফুচকা বানিয়ে স্বপ্নের নায়ককে খাওয়ানোর। পড়াশুনো শিখে প্রিয় নায়কের মতো গাড়ি চড়ার স্বপ্নটা বিসর্জন গেছে গুরুয়া নদীতে। এখন কলকাতা কি পারবে তার আইডলকে ফুচকা বানিয়ে খাওয়ানোর স্বপ্নটা সার্থক করতে?