১৭৪৩ সাল। তৎকালীন হাঙ্গেরির (Hungary) (বর্তমানে অস্ট্রিয়া) রোহঙ্কের লাইব্রেরিতে রহস্যজনকভাবে আবিষ্কৃত হয় চামড়ায় বাঁধানো একটি হ্যান্ডমেড বই (Manuscript)। সেসময় হাঙ্গেরিতে মূলত প্রচলিত ছিল তিনটি ভাষা— ইংরাজি, হাঙ্গেরিয়ান কিংবা জার্মান। তবে আশ্চর্যজনকভাবেই এর কোনোটিতেই লেখা হয়নি এই বই। বইটিকে নিছকই প্রার্থনার বইয়ের বিভাগে আলাদা করে রেখেছিলেন লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। তবে কোন ভাষায় লেখা হয়েছে এই গ্রন্থ? কোথা থেকেই বা রোহঙ্ক লাইব্রেরিতে এসে প্রবেশ করল এই বই? এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামননি তিনি। এই বইয়ের উৎসের অনুসন্ধান শুরু হয় আরও একশো বছর পর।
‘রোহঙ্ক কোডেক্স’ (Rohonc Codex)। হ্যাঁ, এই নামেই পরিচিত রোহঙ্কের লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া সেই প্রাচীন গ্রন্থ। পৃথিবীর ইতিহাসের রহস্যময় গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম রোহঙ্কের লাইব্রেরিতে পাওয়া এই বই। তিনশো বছর পেরিয়ে এসেও যার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি এখনও।
যাই হোক ফেরা যাক মূল গল্পে। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রথম মানুষের টনক নড়ে রোহঙ্ক কোডেক্স নিয়ে। সেটা ১৮৩৮ সাল। গুজটাভ বাথিয়ানি নামে এক সম্ভ্রান্ত হাঙ্গেরিয়ান ব্যক্তি এই বইটি দান করেন হাঙ্গেরিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সকে। যেভাবে রহস্যজনকভাবে যেমন হাঙ্গেরির রোহঙ্ক লাইব্রেরিতে উদয় হয়েছিল এই গ্রন্থের, ঠিক তেমনভাবেই যেন এই গ্রন্থ পৌঁছে গিয়েছিল গুজটাভের পরিবারের কাছে। গুজতাভের অনুমান ছিল তাঁর কোনো পূর্বপুরুষ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন এই বই। কিন্তু রোহঙ্ক লাইব্রেরির খাতায় লিপিবদ্ধ ছিল না তেমন কোনো তথ্যই।
হাঙ্গেরি তথা গোটা ইউরোপে সে-সময় নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে পুনর্জাগরণ, ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মাথা চাড়া দিচ্ছে জাতীয়তাবাদের বোধ। দেশের ঐতিহাসিক নানান নথি, ঐতিহ্য এবং পুরনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে দেশের নানান প্রান্তে। স্বাভাবিকভাবেই সেই তালিকায় যুক্ত হয় রোহঙ্ক কোডেক্স। শুরু হয় গবেষণা।
আরও পড়ুন
নিষিদ্ধ বইয়ের জাদুঘর, ইতিহাসের খণ্ডচিত্র ধরে রেখেছে এস্তোনিয়া
তবে হাঙ্গেরিয়ান পণ্ডিতরা বুঝতে পেরেছিলেন এটি কোনো সাধারণ প্রার্থনার বই নয়। বইটিতে যেমন খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মের আচার-আচরণের নানান সচিত্র বর্ণনা রয়েছে, তেমনই রয়েছে জ্যোতির্বিদ্যা, তান্ত্রিক আচার এবং পৌত্তলিক চিত্রের সমাহার। তার পৃষ্ঠাগুলোও সাজানো অদ্ভুতভাবে। ৪৪৮ পাতার বইটির মধ্যে বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা নেই বলেও অনুমান করেছিলেন তৎকালীন হাঙ্গেরির ঐতিহাসিক এবং পণ্ডিতরা। কিন্তু কার লেখা এই বই?
আরও পড়ুন
মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো বই! পৃথিবীতে এখনও টিকে এমন ১৮টি উদাহরণ
ঐতিহাসিক ক্যারোলি সাজাবো সন্দেহ করেছিলেন, এই গ্রন্থতির রচয়িতা স্যামুয়েল লিটারেটি নেমেস নামে এক ব্যক্তি। তৎকালীন ইউরোপের প্রতারণচক্রের পাণ্ডা তথা কুখ্যাত জালিয়াত ছিলেন নেমেস। প্রত্নসামগ্রীর নকল প্রতিলিপি তৈরি করে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ক্যারোলির সন্দেহ ছিল, এই বইও প্রতারণার জন্যই নিজের তৈরি কোনো ভাষায় লিখেছিলেন নেমেস। তবে ১৭৪৩ সালে রোহঙ্কের লাইব্রেরির খাতায় এই বইয়ের কথা প্রথম লিপিবদ্ধ হওয়ায়, সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পড়েন নেমেস। একদল গবেষক সে-সময় জানিয়েছিলেন ইতালিতে ষোড়শ শতকে লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ। রোহঙ্ক কোডেক্সের পৃষ্ঠার বিশ্লেষণেই এমনটা মনে করেছিলেন তাঁরা। ষোড়শ শতকে এই ধরনের কাগজেই বই লেখার কাজ হত ইতালিতে। তবে পরবর্তীতে কার্বন ডেটিং জানায় রোহঙ্ক কোডেক্সের বয়স প্রায় হাজার বছর।
আরও পড়ুন
বই নয়, বাংলার প্রেসে সর্বপ্রথম ছাপা হয়েছিল একটি ক্যালেন্ডার!
তবে এই বইয়ের আসল রচয়িতার পরিচয় জানা যায়নি আজও। এমনকি পাঠোদ্ধারও সম্ভব হয়নি এই বিশেষ ভাষাটির। কারণ, কার্যত পৃথিবীর কোনো প্রাচীন সভ্যতাতেই হদিশ মেলেনি এই ভাষার। বর্তমান পৃথিবীতেও এই ভাষার অস্তিত্ব নেই। সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে এই গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করতে। তবে সেগুলি ডান দিক থেকে বাঁদিকে লেখা নাকি বাঁদিক থেকে ডানদিকে— তা এখনও বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি ঐতিহাসিকদের পক্ষে। এই ভাষা কোনো প্রাচীন জনগোষ্ঠীর লেখ্যভাষা, এমন সম্ভাবনাও থেকে যায়। কিন্তু তেমনটা হলে এই বইয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির কথা লিপিবদ্ধ হওয়ার কথা নয়।
তবে শুধু মানুষই নয়, রোহঙ্ক কোডেক্সের এই রহস্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-ও। মায়া সভ্যতা কিংবা প্রাচীন ইনকা সভ্যতার পাঠোদ্ধারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল অত্যাধুনিক এআই। রোহঙ্ক কোডেক্সের ক্ষেত্রে সাফল্য পায়নি এইসকল কোড-ব্রেকিং সফটওয়্যারগুলি। ২০১৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদ গাবর টোকাই এবং লেভেন্তে কিরালির যৌথভাবে দাবি করেন, এই গ্রন্থের কিছু সিনট্যাক্স এবং শব্দের পরিকাঠামো বুঝতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। এখনও পর্যন্ত এটাই রোহঙ্ক কোডেক্সের পাঠোদ্ধারের সবচেয়ে আশানুরূপ ফলাফল। তবে সম্পূর্ণ ভাষার শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে আরও কয়েক দশক সময় লাগতে পারে বলেই জানিয়েছিলেন গবেষকদ্বয়। সবমিলিয়ে আবিষ্কারের তিনশো বছর পরেও আজ রহস্যের পর্দাতেই মুড়ে রয়েছে রোহঙ্ক কোডেক্স…
Powered by Froala Editor