যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্রেসার কুকার কিংবা বৈদ্যুতিক কেটল বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে গোটা বিশ্বেই। তবে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা। তবে সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত হয়েছিল এমনই এক পদ, যা রান্না করতে গেলেই দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসত রাঁধুনির ওপর। অবধারিতভাবে বিস্ফোরিত হত প্রেসার কুকার। এমনকি নথি অনুযায়ী, এহেন বিস্ফোরণে আহতও হয়েছেন সে-দেশের বহু কুক। কিন্তু কী কারণে এই বিস্ফোরণ? এমন কি বিস্ফোরক পদার্থ ব্যবহৃত হয়েছিল এই রান্নার উপকরণে যা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবারই?
সিল্কি ক্যারামেল স্লাইস (Silky Caramel Slice)। ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাস। মার্কিন প্রকাশনা সংস্থা ‘র্যান্ডম হাউস’ থেকে প্রকাশ পেয়েছিল একটি বিশেষ রান্নার বই, ‘উইমেন’স ডে ক্রোকারি কুজিন’। যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই ইতালি, ফ্রান্স, চিন-সহ বিভিন্ন দেশের হরেক কিসিমের রেসিপিই লিপিবদ্ধ করা হয় এই বইটিতে। নথিভুক্ত হয় কিছু অভিনব রান্নার পদও। যা কিনা তার আগে রান্না হয়নি অন্য কোনো দেশে। ‘সিল্কি ক্যারামেল স্লাইস’ তেমনই একটি পদ।
প্রথমিকভাবে বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও, ধীরে ধীরে কুখ্যাত হয়ে ওঠে ‘র্যান্ডম হাউস’ দ্বারা প্রকাশিত এই বইটি। আর তার নেপথ্যে ২৩০ এবং ২৩১ পাতায় বর্ণিত ‘সিল্কি ক্যারামেল স্লাইস’-এর রেসিপি। এই পদ রান্না করতে গিয়েই বিস্ফোরণ ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে। আহতও হন বেশ কয়েকজন। প্রথমে বিষয়টিকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা মনে হলেও, পরবর্তীতে দেখা যায় গলদ রয়েছে রেসিপিটিরই। যে-কোনো কুকারে রান্না করতে গেলেই বিস্ফোরিত হচ্ছে সেটি।
ব্যাপারটা জানাজানি হতে টনক নড়ে প্রকাশনা সংস্থার। তড়িঘড়ি ছাপানো হয় বিশেষ বুলেটিন। জানানো হয়, এই বিশেষ পদটি যেন রান্নার চেষ্টা না করেন কোনো পাঠক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত বড়ো বড়ো সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল তার বিজ্ঞাপন। এমনকি বইটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে, এ-দাবিও ওঠে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কিন্তু এই পদ রান্না করতে গিয়ে অবধারিতভাবে কেন বিস্ফোরণ ঘটছে বার বার?
প্রশ্নের উত্তর পেতে শুরু হয় তদন্ত। পরীক্ষামূলকভাবে বন্ধ ঘরে এই পদ রান্নার চেষ্টা করেন বিশেষজ্ঞরা। সেখান থেকেই খোলসা হয় রহস্য। আসলে এই রন্ধনপ্রণালীর একটি ধাপে বলা হয়েছিল, ক্যান-জাত কনডেন্স মিল্ককে ৪ ঘণ্টা প্রেসারকুকারের মধ্যে রেখে গরম করার কথা। আর এই বিশেষ ধাপটিই ‘ঘাতক’ করে তুলেছিল রেসিপিটিকে। সাধারণত, কাচের ঢাকনাযুক্ত টিনের ক্যানেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাওয়া যেত কনডেন্স মিল্ক। এই ক্যান গরম হতে থাকলে, ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি পেত তার। আর উচ্চচাপের কারণেই একটা সময় বিস্ফোরিত হত সেটি। সঙ্গে ফেটে পড়ত প্রেসার কুকারের কাচের ঢাকনাও। প্রশ্ন ওঠে, গ্রন্থের লেখক নিজে একবারও রান্না করে দেখেননি এই বিশেষ পদ? সবটাই নিজের মনমতো লিখে ছাপিয়ে দিয়েছেন এই গ্রন্থে?
না, ব্যাপারটা তেমন নয় একাবারেই। আসলে, এখানে জড়িয়ে রয়েছে ছাপাখানার গলদ। বইটি ছাপার সময় বাদ চলে যায় একটি লাইন। যেখানে বলা হয়েছিল, ঠান্ডা জলের মধ্যে ক্যানটি বসিয়ে তারপর তা উত্তপ্ত করতে হবে প্রেসার কুকারে। তাতে উত্তপ্ত হলেও ক্যানের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে না। তেমন হলে, চাপ বৃদ্ধি হয়ে বিস্ফোরণের আশঙ্কা না থাকাই স্বাভাবিক। তবে এই লাইনটিই বাদ চলে যায় ডিটিপির সময়। যা ঘাতক করে তোলে রেসিপিটিকে।
মজার বিষয় হল, এই গ্রন্থ নিষিদ্ধ করার দাবি উঠলেও, শেষ পর্যন্ত তা থেকেই যায় বাজারে। বরং, পরবর্তীতে সংশোধিত আকারে ফের প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। এবং ‘সিল্কি ক্যারামেল স্লাইস’-খ্যাত সেই ‘ঘাতক’ পদ বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষত শিশুদের মধ্যে। ১৯৭৮ সালের ২৫ মে এই রেসিপি নিয়ে আস্ত একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছিল শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকায়। লিখেছিলেন খ্যাতনামা খাদ্য-সমালোচক মেরিলিন মার্টার। তারপর বহু জল গড়িয়েছে মিসিসিপি দিয়ে। কেটে গেছে প্রায় ৪৫ বছর। তবে আজও সেই রেসিপি-বুকের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ‘ঘাতক’-এর কুখ্যাতি…
Powered by Froala Editor