লন্ডনের বইবাজার। দোকানে দোকানে বিশেষ একটি বই খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক প্রবীণ ব্যক্তি। নাম, ‘ফ্লাই ফিশিং : মেমোরিস অফ অ্যাঙ্গলিং ডেস’ (Fly Fishing : Memories of Angling Days)। লেখক, জে. আর. হার্টলি (J. R. Hartley)। তবে গোটা কয়েক দোকান ঘুরে ফেলার পরেও হতাশ হয়েই শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে হল তাঁকে। তবে বাড়ি ফেরার পরই, তাঁর দিকে হলুদ রঙের একটি পত্রিকা এগিয়ে দিলেন তাঁর সন্তান। উপরে লেখা ‘ইয়েলো পেজেস’। সেই বইয়ের ভেতরেই রয়েছে ‘ফ্লাই ফিশিং’-এর ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন। তার নিচে বিক্রেতার নাম ও ফোন নম্বর। সে-নম্বরে ফোন করতেই মুহূর্তের মধ্যেই জানানো হল নির্দিষ্ট সময়ে বই পৌঁছে যাবে ঠিকানায়। কিন্তু কার নামে পাঠানো হবে ডাকটি? বৃদ্ধ উত্তর দিলেন, জে. আর. হার্টলি।
আজ-কাল গ্রন্থ প্রকাশের বহু আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রকাশিতব্য বইয়ের মার্কেটিং কিংবা প্রচার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তো বটেই, সোশ্যাল মিডিয়াতেও হামেশাই দেখা যায় সেই বই সংক্রান্ত বিভিন্ন ছবি ও বিজ্ঞাপন। কখনও আবার বইয়ের বিশেষ কোনো অধ্যায়ের কিয়দংশের ছবি বা টুকরো কবিতাও ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন হিসাবে। অনেকটা সিনেমার ট্রেলারের মতোই। কিন্তু বই লেখার পরিকল্পনা করা বা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার আগেই যদি পাঠকমহলে রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে ওঠে কোনো বই? হ্যাঁ, ‘ফ্লাই ফিশিং : মেমোরিস অফ অ্যাঙ্গলিং ডেস’-এর ক্ষেত্রে হয়েছিল এমনটাই।
১৯৯৪ সাল। ওয়াশিংটনের বেলভিউ-এ আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘আমাজন’। সেই শুরু। তারপর ‘ই-কমার্স ওয়েবসাইট’ বা ‘অনলাইন শপিং’ বিষয়টি দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের। তবে তারও প্রায় বছর দশেক আগেই একইধরনের পরিষেবা চালু হয়েছিল ব্রিটেনে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত ওয়েবসাইট বা ইন্টারনেট সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়নি। ফলে, পত্রিকা এবং টেলিফোনের মাধ্যমেই চলত সে-যুগের ‘অনলাইন শপিং’। নেপথ্যে, ‘ইয়েলো পেজেস’। নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তার বৈশিষ্ট্য। সাদা কাগজের বদলে হলুদ পাতায় ছাপা হত এই বই। কেবলমাত্র নানা ধরনের বিজ্ঞাপনই ছাপা হত এই বিশেষ পত্রিকায়। সঙ্গে সেখানে লেখা থাকত বিভিন্ন পণ্য-বিক্রেতার নাম এবং ফোন নম্বর। সেখানে ফোন করে নাম-ঠিকানা দিলেই পছন্দের পণ্য পৌঁছে যেত ক্রেতাদের বাড়িতে।
১৯৮৩ সালে ব্রিটেনে এই পরিষেবা চালু হওয়ার পর, তার বিজ্ঞাপন হিসাবেই বানানো হয়েছিল মিনিট খানেকের একটি ভিডিও। ব্রিটেনের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে হামেশাই দেখানো হত সেই বিজ্ঞাপন। এই লেখার শুরু হয়েছিল, এক বৃদ্ধের বই খোঁজার গল্প দিয়ে। আদতে এটিই ছিল ‘ইয়েলো পেজেস’-এর বিজ্ঞাপন। অন্যদিকে এই বিজ্ঞাপনে বয়স্ক ব্যক্তিটির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা নরম্যান লুমসডেন।
এই বিজ্ঞাপন ব্রিটিশ দর্শকদের যে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরেই এক ধাক্কায় বেড়েছিল ‘ইয়েলো পেজেস’-এর বিক্রি ও আনুষঙ্গিক ব্যবসা। তবে ব্রিটিশ পাঠকমহলে, তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ‘ফ্লাই ফিশিং : মেমোরিস অফ অ্যাঙ্গলিং ডেস’ বইটি। দোকানে দোকানে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। ‘ইয়েলো পেজেস’-এর দপ্তরেও রীতিমতো ফোন আসতে শুরু করে এই গ্রন্থের বিক্রেতার নাম জানতে চেয়ে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত এই নামের কোনো বই-ই লেখা হয়নি বিশ্বের কোনো প্রান্তেই। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে, এই বই ছিল সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কেবলমাত্র ‘ইয়েলো পেজেস’-এর বিজ্ঞাপনের জন্যই মনগড়া একটি বইয়ের নাম ঠিক করে নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ।
তবে এই কাল্পনিক গ্রন্থের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা দেখে, শেষ অবধি সুযোগটিকে কাজে লাগান অ্যাঙ্গলিং বা ফিশিং বিশেষজ্ঞ মাইকেল রাসেল। ‘জে. আর. হার্টলি’ ছদ্মনাম নিয়ে লিখে ফেলেন আস্ত একটি বই। ‘ইয়েলো পেজেস’-এর বিজ্ঞাপনের আদলেই বইটির নাম রাখেন ‘ফ্লাই ফিশিং : মেমোরিস অফ অ্যাঙ্গলিং ডেস’। ১৯৯১ সালে প্রকাশ পায় এই বইটি। বলাই বাহুল্য আলাদা করে এই বইয়ের বিজ্ঞাপন বা প্রচারের প্রয়োজন ছিল না কোনো। কারণ, বিগত আট বছরে ব্রিটেনে গড়ে উঠেছে এই বইটির একটি বিশেষ ‘ফ্যান বেস’। তা-সত্ত্বেও প্রকাশক স্ট্যানলি পল অভিনেতা নরম্যান লুমসডেনকে নিয়োগ করেছিলেন বিজ্ঞাপনের জন্য। বই প্রকাশ অনুষ্ঠান ছাড়াও একাধিক সাহিত্যসভায় মূল লেখক মাইকেল রাসেলের পাশাপাশি ‘জে. আর হার্টলি’-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন তিনিও। এমনকি ভক্তদের স্বাক্ষরও করে দিতেন ‘জে. আর. হার্টলি’ নামে।
সুযোগসন্ধানী মাইকেলের এই বইকে ‘প্রতারণা’ হিসাবে অনেকে কটাক্ষ করলেও, ব্রিটেনে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায় এই গ্রন্থ। শুধুমাত্র ১৯৯১ সালের ক্রিসমাসেই বিক্রি হয়েছিল এই গ্রন্থের ১ লক্ষ ৩০ হাজার কপি। রাতারাতি বেস্ট সেলার হয়ে উঠেছিল ‘ফ্লাই ফিশিং’। আটবার পুনর্মুদ্রণ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রকাশক। তাছাড়া পরবর্তীতে মাইকেলকে লিখতে হয় এই গ্রন্থের একটি সিক্যুয়ালও। কিন্তু সত্যিই কতটা মনোগ্রাহী ছিল এই বই? অধিকাংশ পাঠকই ১০-এর মধ্যে ৮-এর বেশি পয়েন্ট দিয়েছিলেন এই গ্রন্থকে। এমনকি আজও এই গ্রন্থের রেটিং ১০-এ ৯-এর বেশি। তবে এই গ্রন্থের থেকেও বেশি সফল ছিল ‘ইয়েলো পেজেস’-এর বিজ্ঞাপনটি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। ২০১৮ সালে একটি বিশেষ সমীক্ষা চালায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘মার্কেটিং উইক’। লক্ষ্য, ১৯৮০-র দশকে তৈরি বিশ্বের সেরা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনকে বেছে নেওয়া। বলার অপেক্ষা থাকে না, এই সমীক্ষায় জনপ্রিয়তার শীর্ষেই ছিল ‘ইয়েলো পেজেস’-এর বিজ্ঞাপনটি। ছাড়াও ২০০০ সালে ব্রিটেনের একটি গণ-সমীক্ষাতেও দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কমার্শিয়াল হিসাবে সাধারণ মানুষ বেছে নিয়েছিলেন এই বিজ্ঞাপনকেই।
Powered by Froala Editor