চিঠি লেখার রেওয়াজ আজকাল অনেকাংশে উঠেই গিয়েছে। আর ব্যক্তিগত চিঠি পাঠালেও তা সঠিক জায়গায় পৌঁছাবে কিনা, বোঝা মুশকিল। কারণ মানুষ এখন আর একই ঠিকানায় বেশিদিন থাকেন না। আমেরিকায় একজন মানুষ গড়ে ১১.৭ বার ঠিকানা বদলান, পরিসংখ্যানে এমনটাই দেখা গিয়েছে। মানুষ জায়গা বদলায়, কিন্তু ঠিকানা তো জায়গা বদলায় না। দাঁড়ান, একটু ভুল হল। ঠিকানা বলতে যদি পিন কোড বা জিপ কোড বোঝায়, তাহলে তার জায়গা বদলে যেতেই পারে। অন্তত আমেরিকার বুকেই রয়েছে এমন একটি জিপ কোড। ৪৮২২২। এই জিপ কোডটি বাকি কোডগুলির মতো কোনো স্থায়ী পোস্ট অফিসের নয়। বরং একটি সক্রিয় নৌকার।
কানাডা ও আমেরিকার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট নদী ডেট্রয়েট (Detroit River)। আর এই নদীতেই ভেসে বেড়ায় জে ডব্লিউ ওয়েসকোট ২ (J.W. Westcott II)। ৪৫ ফুট লম্বা নৌকাটি সর্বাধিক ১৪ টন মাল পরিবহণ করতে পারে। আর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২৮ কিলোমিটারের চেয়ে কম। ডেট্রয়েট নদীতে বাকি যেসব নৌকা ভেসে বেড়ায়, তাদের অনেকের আয়তন ওয়েসকোটের চেয়ে বেশি। অনেকের গতিবেগ বেশি। কিন্তু একটি বিষয়ে পৃথিবীর সমস্ত নৌকাকে টেক্কা দিতে পারে ওয়েসকোট। আর তা হল, একমাত্র এই নৌকার জন্য রয়েছে পৃথক জিপ কোড। কিন্তু সাধারণ একটি নৌকার জন্য কেন পৃথক জিপ কোড? এর উত্তর পেতে গেলে উঁকি মারতে হবে উনিশ শতকের ইতিহাসে।
নৌকাটির নাম রাখা হয়েছে জন ওয়ার্ড ওয়েসকোট নামের এক নাবিকের নামে। ১৮৬৮ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ডেট্রয়েট নদীতে নৌকা চালানোর অনুমতি পেয়েছিলেন। তবে অন্যান্য নাবিকদের মতো সাধারণ মাল পরিবহণে তাঁর মন টিকল না। তিনি নতুন ধরনের ব্যবসার কথা ভাবছিলেন। ভাবতে ভাবতে পেয়েও গেলেন সেই রাস্তা। নদীতে নৌকা পরিবহণের অন্যতম সমস্যা ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। তখন তো আর অয়ারলেস যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। কোনো নৌকাকে বন্দর থেকে কোনো বার্তা পাঠানোর সহজ কোনো উপায় ছিল না। সেই নৌকা পরের বন্দরে নোঙর ফেললে তবে খবর হস্তান্তর করা যেত।
ওয়েসকোট ঠিক করলেন, তিনি নৌকা নিয়ে মাল পরিবহণ করবেন না। শুধুই চিঠিপত্র পরিবহণ করবেন। বন্দর থেকে বিভিন্ন নৌকায় খবর পৌঁছে দেবেন। মাল পরিবহণ না করায় নৌকা সবসময় হালকাই থাকত। আর ওয়েসকোট নৌকা চালাতেনও বেশ জোরে। তখনও ডেট্রয়েট নদীতে ডিজেল চালিত নৌকার ব্যবহার শুরু হয়নি। তাই নৌকার গতিবেগ নির্ভর করত নাবিকের উপরেই। সে যাই হোক, ওয়েসকোটের ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে উঠতে লাগল। ১৮৭০ সালে তিনি ঠিক করলেন, শুধুই বন্দর থেকে খবর আদান প্রদান নয়। বরং নৌকার কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁদের পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের যোগাযোগের জন্যও চিঠিপত্র বিনিময় করবেন তিনি।
এর মধ্যে ১৮৯০ সালে ডেট্রয়েট নদীতে ডিজেল চালিত নৌকা চালানোর অনুমতি পাওয়া যায়। আর প্রথম ডিজেল নৌকাটি কিনে নেন ওয়েসকোট। ফলে তাঁর নৌকার গতিবেগ আরও বাড়ল। ব্যবসাও বাড়ল। ১৯১৩ সালে ওয়েসকোটের মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর ডাক কোম্পানিটি টিকে গেল। দুটি বিশ্বযুদ্ধে কয়েক লক্ষ ডলার আয় করল এই কোময়ানি। এরপর ১৯৪৯ সালে মার্কিন ডাক বিভাগের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশনও পাওয়া গেল। তখনও অবশ্য আমেরিকায় জিপ কোডের ব্যবহার ছিল না। আরও ১৫ বছর পর জিপ কোডের ব্যবস্থা চালু করে মার্কিন ডাক বিভাগ।
ডাক বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী যে-কোনো চিঠি আদানপ্রদান কেন্দ্রের জন্যই আলাদা আলাদা জিপ কোড থাকতে হবে। বাকি সব কেন্দ্রই এক জায়গায় স্থায়ী। তাই তাদের নিয়ে সমস্যা ছিল না। সমস্যা হল ওয়েসকোট কোম্পানির নৌকাটিকে নিয়ে। প্রথমে ডাক বিভাগের কর্তারা মেনে নিতে পারেননি যে একটি নৌকার আলাদা জিপ কোড থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়ম মানতে বাধ্য হন তাঁরা। আর এভাবেই একটি নৌকার জন্য তৈরি হয় আলাদা জিপ কোড। সম্ভবত এটিই পৃথিবীর একমাত্র চলমান ডাক ঠিকানা। তবে পৃথিবীর সমস্ত ডাক ঠিকানা যদি এমন চলমান হত, তাহলে অবশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা সহজ হত না।
Powered by Froala Editor