অরণ্যের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে রয়েছে অজস্র পাইন, ওকে, বার্চের সারি। সবুজ সামিয়ানা ঢেকে গেছে আকাশ। আর মাটিতে কেউ যেন বিছিয়ে রেখে গেছে আদিগন্ত নীল গালিচা। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে সেই চাদর। হঠাৎ এই দৃশ্যের সাক্ষী হলে মনে হবে, ঠিক যেন হঠাৎ করেই স্বপ্নরাজ্যে এসে হাজির হয়েছেন আপনি।
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস (Brussels) থেকে বাস ধরলে মিনিট তিরিশের রাস্তা। দক্ষিণে ফ্ল্যান্ডার্স ও ওয়ালোনিয়ার সীমান্তে পৌঁছালেই দেখা মিলবে এই আশ্চর্য অরণ্যের। যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত ‘হ্যালারবোস’ (Hallerbose) নামে। যার অর্থ ‘হ্যাল গাছের অরণ্য’। হ্যাল বলতে মূলত ওক এবং বিচ গাছকেই বোঝানো হয় বেলজিয়ান ভাষায়। অবশ্য শুধু এইসকল মহীরুহরাই নয়, এই অরণ্যে বাস ব্লবেল হাইয়াসিন্থ নামের এক ছোটো গুল্মেরও। উচ্চতায় বড়োজোর এক ফুট এই গুল্ম। প্রতিবছর এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত ফুল ধরে এইসকল গাছে। উজ্জ্বল নীলাভ বেগুনি বর্ণের ফুলে ঢেকে যায় গোটা অঞ্চল। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কেউ যেন অরণ্যের মধ্যে বিছিয়ে দিয়ে গেছে নীল কার্পেট। এই আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যের জন্য সাধারণ মানুষের মুখে ‘ব্লু ফরেস্ট’ (Blue Forest) আন্মেই পরিচিত এই অরণ্য।
ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, এই অরণ্য ছিল সোনিয়ান অরণ্য এবং চারকোল ফরেস্টের অংশ। এমনকি ইউরোপের বৃহত্তম ওক এবং বিচের আবাসস্থলও ছিল ব্রাসেলসের দক্ষিণে অবস্থিত এই অরণ্য। পাশাপাশি প্রতি বসন্তেই গোটা অরণ্য ভরে উঠত নীল ব্লুবেলে। কয়েক শতাব্দী ধরেই এই নিয়ম চলে আসছে হ্যালারবোসে।
তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এই গোটা অঞ্চল। রাসায়নিক অস্ত্র এবং বোমার ব্যবহারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রায় গোটা অরণ্যটি। মারা গিয়েছিল হাজার হাজার গাছ। যে-যুগের হাতেগোনা যে-কটি গাছ বেঁচে গিয়েছিল, আজও এই অরণ্যে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। অন্যদিকে বৃহৎ কোনো গাছের ছায়াতেই বেড়ে ওঠে ব্লুবেল। বিশ্বযুদ্ধে এই অরণ্যের মহীরুহরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায়, আকস্মিকভাবে কমে গিয়েছিল তাদের উপস্থিতিও।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০-র দশকের শেষ থেকে নতুন করে এই অরণ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয় বেলজিয়ান সরকার। ১৯৩০-১৯৫০— এর মধ্যে সবমিলিয়ে রোপণ করা হয়েছিল কয়েক লক্ষ স্থানীয় ওক, বিচ, পাইন। বিগত কয়েক দশকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে তারা। ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে এই অরণ্যের স্বাস্থ্য। বর্তমানে ব্লুবেল ছাড়াও এই অরণ্যে দেখা মেলে সোরেল নামের আরও এক ফুল ও বন্য রসুনের। তাছাড়াও বসন্তে ব্ল্যাকক্যাপ, ওয়ারব্লার, রেনস, নুথাচ-সহ একাধিক প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে ভরে ওঠে হ্যালারবোস। বিপন্নপ্রায় লাল কাঠবেড়ালিদের বাসস্থানও এই অরণ্য। বর্তমানে এই অরণ্য বেলজিয়ামের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হলেও, প্রকৃতি সংরক্ষণে একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বেলজিয়ান সরকার। প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে শুরু করে ক্যাম্পিং, বনভোজন— সবকিছুই নিষিদ্ধ হ্যালারবোসে। ফটোগ্রাফির জন্যও বিশেষ অনুমতি নিতে হয় বেলজিয়ামের বনদপ্তরের থেকে।
Powered by Froala Editor