দুঃস্বপ্নে হানা হিটলারের, যৌথ গবেষণায় ভাঙন; নোবেলই মিলিয়ে দিল দুই বিজ্ঞানীকে

২০১২ সাল। দুই বিজ্ঞানীর যৌথ গবেষণায় উঠে আবিষ্কৃত হল জিন-টেকনোলজির এর যুগান্তকারী পদ্ধতি। যেকোনো জীবিত কোষের জিন-কাঠামো বদলে দিতে পারে এই পদ্ধতি। সেই উনিশ শতকের শেষ থেকে বিজ্ঞানীরা কেবল এমনটা কল্পনাই করেছেন। জন্ম নিয়েছে কল্পবিজ্ঞানের নানা কাহিনি। তবে এবার আর কল্পনা নয়। নিজেদের আবিষ্কারে নিজেরাই মুগ্ধ হলেন দুই বিজ্ঞানী। একের পর এক পুরস্কার এবার তাঁদের হাতের মুঠোয় এসে পড়বে। আর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও যে যথেষ্ট গুরুত্ব রাখবে এই আবিষ্কার, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

কিন্তু এর মধ্যেই একদিন একটি স্বপ্ন দেখলেন গবেষকদের একজন। স্বপ্নে তাঁর সামনে এসে হাজির অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার জানতে চান তাঁদের গবেষণার বিষয়ে। বলা বাহুল্য, সেই জানতে চাওয়া বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য নয়। তার মধ্যে নিহিত আছে রাজনৈতিক কারণ। মানুষের সভ্যতাকে যেমন নতুন দিশা দেখাতে পারে এই আবিষ্কার, তেমনই ডেকে আনতে পারে সভ্যতার সংকটও। বিচ্ছেদের সূত্রপাত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। জেনিফার ডাউডনা আর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই আবিষ্কারকে ব্যবহার করতে দিতে চান না। মাঝেমাঝেই রাতের দুঃস্বপ্ন তাড়া করে তাঁকে।

অন্যদিকে ইমান্যুয়েল শার্পেন্টিয়ার কিন্তু এমন দুশ্চিন্তাকে পাত্তা দিতে রাজি নন। অন্যান্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো এটাও একটা আবিষ্কার। মানুষের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে এই আবিষ্কার। সমস্যার সমাধান হল না। একুশ শতকের সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত দুই বিজ্ঞানীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটল অচিরেই। শার্পেন্টিয়ার কিছুদিন ডাউডনার গবেষণাগারেই কাজ করেছেন। এবার তিনি নিজের জন্য আলাদা গবেষণাগার তৈরির চেষ্টা করতে থাকলেন। আর আবিষ্কারের পেটেন্ট কে পাবেন, তাই নিয়েও শুরু হল মামলা।

পেটেন্টের মামলায় হাজির হল আরও দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান। হাভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং ব্রড ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সাফল্য পেয়েছে। ডাউডনা এবং শার্পেন্টিয়ার তাঁদের মডেল জমা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ কতটা সম্ভব সেটা তাঁরা বলতে পারেননি। অতএব এই আবিষ্কারের পেটেন্ট পাওয়া উচিৎ হাভার্ড ইউনিভার্সিটি বা ব্রড ইনস্টিটিউটের। এমনটাই দাবি করেছিলেন তাঁরা। মামলা চলল টানা ৫ বছর। অবশেষে জেনিফার ডাউডনা এবং ইমান্যুয়েল শার্পেন্টিয়ারের মধ্যেই পেটেন্টের অধিকার ভাগ করে দেওয়া হল। ডাউডনা ইউক্যারিওটিক কোষে এই পদ্ধতির প্রয়োগের পেটেন্ট পেলেন। আর শার্পেন্টিয়ার পেলেন প্রোক্যারিওটিক কোষের পেটেন্ট।

আরও পড়ুন
অঙ্কে ভয় পেতেন ছোটোবেলায়, নোবেল জিতে সেই অতীতকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন রজার পেনরোজ?

এবছর নোবেল ফাউন্ডেশনের ঘোষণা অনুযায়ী রসায়নে পুরস্কার পাচ্ছেন জেনিফার ডাউডনা এবং ইমান্যুয়েল শার্পেন্টিয়ার। আর পুরস্কারের কারণ ২০১২ সালের সেই আবিষ্কার, ক্রিসপার-ক্যাস৯। এতদিনের নানা জল্পনার মধ্যেই আবারও একসঙ্গে পুরস্কার নিতে দেখা যাবে দুই বিজ্ঞানীকে। অবশ্য মহামারী করোনার প্রেক্ষাপটে তাঁরা একসঙ্গে মঞ্চে ওঠার সুযোগ পাবেন না। দুজনেই পুরস্কার নেবেন নিজেদের বাড়িতে বসেই। তবে এর মধ্যেই কি কোথাও ফুটে উঠবে না একসঙ্গে কাজ করার স্মৃতি!

দুই বিজ্ঞানীর বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি। জেনিফার ডাউডনা এখনও মনে করেন, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ক্রিসপারের ব্যবহারের সময় এখনও আসেনি। যদিও একসময় তিনি বলেছিলেন, কখনোই এটা ব্যবহার করা উচিৎ নয়। কিন্তু এখন সেই মত খানিকটা শিথিল হয়েছে। নানা জিনগত রোগের চিকিৎসায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে, মনে করছেন তিনি। কিন্তু তার পরেও সভ্যতার সংকটের আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্যদিকে ইমান্যুয়েল শার্পেন্টিয়ার এখনও বিশ্বাস করেন, কীভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে সেটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

আরও পড়ুন
ব্ল্যাকহোলের রহস্যে উঁকি দিয়ে পদার্থবিদ্যায় নোবেল তিন বিজ্ঞানীর

তবে থ্যালাসেমিয়া, ক্যানসারের পাশাপাশি নানা ভাইরাসের চিকিৎসায় যেমন এই আবিষ্কার কাজে লাগতে পারে, তেমনই এই পদ্ধতির যথেচ্ছ প্রয়োগ নানা প্রজাতির বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিতও করতে পারে। তার প্রভাব সত্যিই খুব একটা ভালো হবে না। ২০২০ সালের রসায়নের এই পুরস্কার তাই যেন আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে স্যার অ্যালফ্রেড নোবেলের কথাই। নিজের আবিষ্কারের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাই তাঁর শেষ জীবনে দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। ডাউডনার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে যেন তারই মিল পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্রঃ Interview of Jennifer Doudna, by Hannah Devlin, The Guardian
Nature
Berkeley University

আরও পড়ুন
হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কার করে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী

Powered by Froala Editor

More From Author See More