২০১১ সাল। পাঞ্জাবের ফিরোজপুর শহরে চলছে সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠান। শেষ হল বেশ রাত করেই। রাতের খাওয়াদাওয়ার পর বাইরে বেরিয়েছিলেন মনজিৎ সিং (Manjit Singh)। বাড়ি চণ্ডীগড়ে (Chandigarh), যুক্ত পরিবেশ সংরেক্ষণের কাজে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে ৫০ জন শিশু-কিশোর নিয়ে এসেছিলেন সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে। কিন্তু, সেদিন রাতে বদলে গেল জীবন। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে রাস্তা পরিষ্কার করছিলেন এক কর্মচারী, খানিক কৌতূহলবশত সেই দিকে এগিয়ে যান মনজিৎ। লক্ষ করেন, সমস্ত আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে একটি মৃত পায়রা। আকারে খুব বড়ো নয়, সম্ভবত বিদ্যুতের তারের সংস্পর্শে হয়েছে এই পরিণতি। কিন্তু, তা বলে এভাবে জঞ্জালের স্তূপে হবে শেষ ঠিকানা? তারা কি এতোটাই অশ্রদ্ধার পাত্র? উত্তর নেই কোনো। পরের চারটে দিন তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল প্রশ্নগুলো।
ফিরে এলেন চণ্ডীগড়ে। শহরের ইট-কাঠের জঙ্গলে পাখিদের মৃত্যু দেখে অভ্যস্ত চোখ হয়তো ভুলে যেতে পারত সব কিছু। মনজিৎ ভুললেন না। সমাধানের জন্য গেলেন অনেকের কাছেই। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন বুদ্ধি। নিজের ছিল একটি পরিবেশবান্ধব সাইকেল। সেটিকে করে তুললেন ‘পাখিদের অ্যাম্বুলেন্স’ (Bird Ambulance)। তারপর থেকে চণ্ডীগড়ের বিভিন্ন রাস্তায় মনজিৎ ঘুরে বেড়ান অসুস্থ পাখিদের সেবার জন্য। মৃত পাখিদের ঠিকানা যেন ডাস্টবিন না হয়, সেদিকেও নজর তাঁর। অনেকে ডাকেন ‘প্রিন্স মেহরা’ (Prince Mehra) বলে, তবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘পক্ষীমানব’ (Bird Man) নামটি। বর্তমানে যুক্ত চণ্ডীগড় সরকারের পশু সেবালয়ের সঙ্গে। আর তার ফাঁকেই চলে পাখিদের ফের আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
আসলে মনজিৎ সিং মানুষটা কখনও চাননি খাঁচায় বন্দি হতে। দশটা পাঁচটার সুখী ব্যাঙ্কের চাকরি পর্যন্ত খারিজ করে দিয়েছিলেন সেবামূলক কাজ করবেন বলে। আরও অনেক আগে, ১৯৯০ সালে শুরু হয় সেই ইতিহাস। তখন তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অঙ্কন-শিক্ষক। মানুষের চর্চার তালিকার প্রথম সারিতে আসেনি পরিবেশ দূষণ বিষয়টি। সেই সময়ই মনজিৎ চালু করেন পরিবেশবান্ধব বাইক চালানো। বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে থাকেন বাকিদেরও। ১৯৯৯ সালে বিয়ের পরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন পরিবেশরক্ষার কাজে। চিন্তিত শ্বশুরবাড়ির লোকজন ব্যাঙ্কে একটি চাকরির ব্যবস্থাও করে দেয়। কিন্তু, ততদিনে নিজের ডানায় ভর দিয়ে ওড়ার সাহস পেয়ে গেছেন তিনি। প্রথম দিকে খানিক মান-অভিমানের পালা চললেও পরে সমর্থন পান স্ত্রীর থেকেও।
অবশেষে ২০১১-এ জীবনে এল নতুন বাঁক। তিনি খেয়াল করেছেন, অধিকাংশ পাখিই আহত হয় মানুষের সভ্যতার ফাঁদে। সাধারণত বিদ্যুতের তারে কিংবা পাখার ধারালো ব্লেডে। দ্রুত চিকিৎসা হলে অধিকাংশ সময়ে বাঁচিয়েও তোলা যায়। তাই তাঁর সাইকেলে সবসময় মজুত থাকে পাখি চিকিৎসার সরঞ্জাম। দুপুর তিনটে থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে ‘কল’ এলেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দ্রুত পৌঁছে যান সেখানে। পাখিদের সুস্থ করে প্রাথমিক বাসা বেঁধে দেওয়া হয় চণ্ডীগড়ের পাখিরালয়ে, পরে ছেড়ে দেওয়া হয় খোলা আকাশে। আবার, গ্রীষ্মকালে চণ্ডীগড়ের দাবদাহে ও জলকষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেক পাখি। তাদের জন্যও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে ব্যস্ত থাকেন ৫৪ বছরের মনজিৎ। এখনও পর্যন্ত তাঁর হাতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে বারোশো-র উপর পাখি। পায়রা, টিয়া, ঘুঘু-সহ নাম-না জানা পাখিদের নিয়েই এখন তাঁর সংসার। স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে সম্পন্ন করেছেন হাজারের বেশি পাখির শেষকৃত্য। নাম উঠেছে ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ডস’-এও। ‘পক্ষীমানব’ নামে একডাকে তাঁকে চেনে চণ্ডীগড়বাসী।
আরও পড়ুন
নিজ হাতে পাখিদের খাসা বাসা তৈরির নায়ক হিন্দোল আহমেদ
খুশি মনজিৎ নিজেও। মানুষের সচেতনতা বেড়েছে, অনেকে স্বেচ্ছায় হাত লাগাচ্ছে পাখিদের সুস্থ করার কাজে। দূষণ, বৃক্ষচ্ছেদন, নগরায়ণের সমস্যা তো রয়েছেই, তা বলে প্রশ্ন ওঠে না হাল ছাড়ার। খুব বেশি দাবি নেই জীবনে। নিজের সন্তানদের কাছে যেন তৈরি করতে পারেন দৃষ্টান্ত। আর দেখতে চান পাখিদের ভরভরন্ত সংসার। কোনো মা দিনান্তের শেষ খাবারটি তুলে দিচ্ছে ছানার মুখে। আগলে রাখছে ডানা দিয়ে। আর কোনো চিন্তা নেই, ভয় নেই। বিপদ এলে সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যাম্বুলেন্স’-এ করে হাজির হবেন চণ্ডীগড়ের ‘পক্ষীমানব’ মনজিৎ সিং।
আরও পড়ুন
আড়াই লক্ষাধিক ‘গৃহহীন’ পাখিদের বাসায় ফিরিয়ে নজির দিল্লির ‘নেস্ট ম্যান’-এর
চিত্রঋণ : Pedal And Tring Tring
Powered by Froala Editor