বাংলা হরফ আর ছবিতে বিশাল দেওয়ালচিত্র, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াই মিশিগানে

বিশাল দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একটি ছবি। ছবি নয়, ছবির কোলাজ বলাই ভালো। সেখানে যেমন দেখা যাবে শাড়ি পরিহিত এক যুবতীকে, তেমনই চোখে পড়বে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, শালুক ফুল, চা-বাগান আর শহিদ বেদি। সেইসঙ্গে নজরে আসবে বড়ো করে লেখা কয়েকটি অক্ষর— ‘অ’, ‘আ’, ‘ক’, ‘খ’। হ্যাঁ, বাংলা অক্ষরমালাই। তবে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বাংলাদেশ নয়, এই ছবি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রদেশের।

২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর। ডেট্রয়েটের হ্যামট্রামক শহরের চার্ট স্ট্রিটের ব্রিজ অ্যাকাডেমি ওয়েস্ট স্কুলের দেওয়ালে আঁকা হয়েছিল ৪৬ ফুট উঁচু এই ছবি। যেখানে মূলত পঠনপাঠন করে বাঙালি, আফ্রিকান এবং আরবিয়ান শিশুরা। উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাছে বর্ণবাদ এবং বৈষম্য দূরীকরণের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। হ্যামট্রামক ভিত্তিক বাঙালি সংস্থা ‘ওয়ানহ্যামট্রামক’-এর দৌলতেই ভাষা পেয়েছিল এই দেওয়াল-চিত্রণ।

আসলে ভারত কিংবা বাংলাদেশে যেমন প্রতিনিয়তই চলছে মাতৃভাষার জন্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই, ঠিক একইভাবেই এই আন্দোলন চলছে মার্কিন প্রদেশেও। মার্কিন নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনের পর যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ বাঙালি বসবাসকারী শহর হল হ্যামট্রামক। আর তাঁদের অধিকাংশই বাংলাদেশের অভিবাসী। কেউ হয়তো সেখানে আস্তানা নিয়েছিলেন সত্তরের টালমাটাল সময়ে। আবার আশি, নব্বইয়ের দশকেও কর্মসূত্রে হাজির হয়েছেন মার্কিন প্রদেশে। 

তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য জায়গায়। তাঁদের সন্তানরা সকলেই বড়ো হয়ে উঠছে মার্কিন প্রদেশে। পঠনপাঠনের সিলেবাসেও রয়েছে সেই দেশের ইতিহাসই। সেখানে কোথাও যেন মাতৃভূমিকে চিনতে পারছে না তারা। জানতে পারছে না বাংলাভাষার মাধুর্যকেও। প্রবাসী হয়েও তারা যেন সামান্য হলেও নিজের দেশের ছবির ধারণা পায়, অনুপ্রেরণা পায় নিজের দেশের বিষয়ে বিষদে জানার— সে জন্যই নেওয়া হয়েছিল এই উদ্যোগ। 

আরও পড়ুন
নেই কোনো প্রথাগত শিক্ষা, ৪টি ভাষায় ১২.৫ লক্ষ শব্দের অভিধান লিখলেন কেরালার বৃদ্ধ

শুধু তাই নয়, এই দেওয়ালচিত্র যেন তাঁদের অস্তিত্বের চিহ্নও। অনেক সময়ই মার্কিন প্রদেশে বাংলাদেশি কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয় ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি হিসাবে। তবে বাংলাদেশ যে সত্যিই পৃথক একটি রাষ্ট্র, পৃথক একটি সংস্কৃতি, তা বোঝাতেই এই উদ্যোগ সংস্থাটির। 

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে মাত্র ৮-১০টি বাঙালি পরিবারের বসবাস ছিল হ্যামট্রামকে। কেউ কেউ সেখানে কাজ করতেন দোভাষীর। এখন সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে হাজারের কাছাকাছি। আর ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের বাইরেও তাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন বাংলার সংস্কৃতিকে। শহরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন উপাসনালয়, সাম্প্রদায়িক সংগঠন, সামাজিক সহায়তা কেন্দ্র। 

আরও পড়ুন
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, কৃষ্ণাঙ্গ সান্তা ক্লজের জন্ম দিয়েছিল মার্কিন প্রদেশ

বছর তিরিশেক আগেও ডেট্রয়েটের ওই স্কুল ভবনটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ছিল একটি প্রাচীন হাসপাতাল। বাংলাদেশের মানুষরাই তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজেদের কাঁধে। পরে সেখানে স্কুল তৈরি ক্ষেত্রেও ভূমিকা রয়েছে তাঁদেরই। সেই ইতিহাসেরও যেন খণ্ডচিত্র এই দেওয়াল। দলিল, দেশের বাইরে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাত ধরেই আদালতে ঢুকেছিল বাংলা ভাষা