মূর্তি নয়, পুজো হত পদচিহ্নেই; ধীরে ধীরে আলপনায় মিশে গেল লক্ষ্মীর পা

নবমী নিশি পেরিয়ে গেছে কবে! আস্তে আস্তে চাঁদের ষোলো কলা পূর্ণ হচ্ছে আকাশে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার প্রতিটা উঠোনে। আর সেখানেই শোনা যায় সেই চিরন্তন সুর, ‘কে জেগে আছো?’ লক্ষ্মী ঠাকরুন ঘরে ঘরে হাজির হচ্ছেন। আর বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর পায়ের ছাপ। দুর্গাপূজার পরপরই  সৌভাগ্যের ডালি নিয়ে হাজির হন তিনি। আর বাংলার ঘর সেজে ওঠে আলপনা আর ধানের শিষে… 

লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে আলপনা জড়িয়ে গেছে প্রবলভাবে। সেই কোন আদ্যিকাল থেকে গ্রামবাংলার ঘর, দাওয়া সেজে উঠত নানা অলংকরণে। যুগ বদলেছে; কিন্তু সেই রীতি বদলায়নি আজও। অবশ্য লক্ষ্মী  তো কেবল একটি দিনের অতিথি নন। প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁর আরাধনা চলে বাংলার ঘরে। সবার কাছে এটা একটা ব্রত। আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, একটা লক্ষ্মীর পাঁচালি আর ঘট না থাকলে ঠাকুরের আসনটা কেমন খালি খালি লাগে। আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই ঢুকে গেছে এমন পরম্পরা… 

আশ্বিনের সন্ধ্যা। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে শোভা বাড়িয়েছে। আগেই ক্ষেত থেকে শস্য ঘরে নিয়ে এসেছে ছেলেরা। এবার সেই ধনের আরাধনা করতে হবে না! সন্ধের জ্যোৎস্নায় মেয়েরা আলপনায় সাজিয়ে দিত ঘর। সব সারা হলে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনায় মেতে উঠত ঘরের মেয়েরা। একটা সময় এটাই ছিল প্রচলিত রীতি। তখন অবশ্য সব জায়গায় মূর্তির প্রচলন ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলপনার মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হত অবয়ব। অবয়ব  বলতে লক্ষ্মীর পা, ধানের ছড়া এবং পেঁচা। ব্যস, চৌকি পেতে শুরু হত ব্রতপালন। কখনও  কখনও  লক্ষ্মীর সরা শোভা পেত সেই চৌকিতে। ধীরে ধীরে যত সময় এগিয়েছে, বদলেছে পুজোর ধরণ। এখন  মূর্তি বা ছবি ঢুকেছে ঘরে ঘরে। তাকে সামনে রেখে, চৌকি পেতে শুরু হয় পূজা। সরাও কি আর দেখা যায় সেরকমভাবে?

শহরের বাইরে যাওয়া যাক। গ্রাম বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে লক্ষ্মী আরাধনা জুড়ে আছে প্রবলভাবে। তার নানা রূপ, নানা আচার। আর রয়েছে আলপনা। আগেই বলেছি, মূর্তিপূজার বদলে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর পা, ধানের ছড়া আঁকা হত। সেইসঙ্গে থাকত অন্যান্য অনুসঙ্গ, অলংকরণ। কোনো নির্দিষ্ট রীতি ছিল না সেখানে; এক এক বাড়ির আলপনা এক এক রকম। কিন্তু লক্ষ্মীর পা থাকতই। আর ধান তো লক্ষ্মীর প্রতীকই। এই সবকিছু নিয়ে শুরু হত ব্রতকথা। 

বাংলার আলপনা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন গবেষক রবি বিশ্বাস। লক্ষ্মীর আলপনা নিয়েও তাঁর গবেষণা ইতিমধ্যেই সমাদৃত। কথাপ্রসঙ্গে প্রহরকে জানালেন, “লক্ষ্মীপুজোর আলপনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল লক্ষ্মীর পা। এই পা কিন্তু একদিনে আসেনি। আলপনার সঙ্গেই বিবর্তিত হতে হতে আজ তার এই অবস্থান। প্রাগৈতিহাসিক সময়ের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে শিকার করতে যাওয়ার সময় পায়ের ছাপ দেখেই মানুষ বুঝে যেত কোন জন্তু এসেছিল। ফলে তাদের চিহ্নিতও করা যেত সহজে। এইভাবেই চিহ্নের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে শিখেছিল সেই সময়কে। গুহাচিত্রের নমুনাও আমাদের সামনেই আছে। যত সময় এগোতে লাগল, তত এই চিহ্নের বিবর্তন হতে লাগল। এবং সেই পথ ধরেই লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবেই তাঁর পায়ের ছাপের আগমন। কারণ আগেকার দিনে লক্ষ্মীর মূর্তি হত না। আলপনা দিয়ে নানা অনুসঙ্গ এঁকেই পুরোটা করা হত। সেক্ষেত্রে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ সেই দেবীত্বের আগমনকেই বলে দেয়। আর চাষের ফসল, শিকার করে নিয়ে আসা খাবার ইত্যাদি সমস্তই তো সম্পদ। আর লক্ষ্মী তো সেই সম্পদেরই দেবী। এইভাবেই লক্ষ্মীর পায়ের প্রচলন আলপনায় চলে আসে।”

এইভাবেই আলপনাও এগোতে থাকে। লক্ষ্মীর পায়ের সঙ্গে ধানের শিষ তো পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে; সেইসঙ্গে নিজের মনমতো নকশা দিয়ে ভরে ওঠে এক একটা ঘর। তবে সব ঘরেই যে একরকম  থাকে তা নয়। “কেউ ধানের গোলা আঁকছে, কেউ শঙ্খ, পদ্ম, আবার মই আঁকারও প্রচলন দেখা গেছে। এর কোনো নির্দিষ্ট ধরণ বা ধাঁচ নেই। যে যেমন জীবিকার সঙ্গে যুক্ত, সে সেইভাবে তাঁর আরাধনা করছে। আর সেইভাবেই সেজে উঠছে আলপনাও। আর পুজোরও নানা রূপ। কোথাও মূর্তি থাকছে, আবার কোথাও থাকছে সরা, কলাগাছ, ধানের আড়ি, নৌকা। সেই সমস্তই লোকগল্প, লোকাচার। অদ্ভুতভাবে, বৈদিক যুগের আগে কিন্তু লক্ষ্মীর তেমন পূজা হত না। তখন, এবং তারও পরে কিন্তু টিকে ছিল এই লোকাচার, ব্রতকথাগুলোই। গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, প্রায় ৩০-৪০ রকমের লক্ষ্মী পুজোর আচার ছড়িয়ে আছে গোটা বাংলায়”, বলছিলেন রবি বাবু… 

আরও পড়ুন
লোককথা থেকে পূজার আসন, বাঙালির ‘ঘরের মেয়ে’ লক্ষ্মী বিরাজমান সর্বত্রই

লক্ষ্মীদেবী কেবল পুজোতেই আটকে থাকেন না। এখনও  নদিয়া, পুরুলিয়ার মতো জায়গায় লক্ষ্মীপূজাকে কেন্দ্র করে মেলা বসে, ছৌ নাচ হয়। পুজোকে কেন্দ্র করে গান তৈরি হয়। পাঁচালির বাইরে গিয়েও লক্ষ্মী হয়ে ওঠেন ঘরের মানুষ। নিজের মতো করেই আরাধনা চলে তাঁর। তবে সবক্ষেত্রেই এই পায়ের আলপনাটি দেখা যায়। আর অন্য পুজোর সময় কি সেভাবে দেখা যায়? এই প্রশ্নটি হয়তো অনেকের। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল, সমস্ত পুজোয় যে পদচিহ্ন আমরা ব্যবহার করি, তা আসলে লক্ষ্মীরই। “আর সেটাই আমরা সমস্ত জায়গায় ব্যবহার করি। এমনকি, এখনকার স্টিকার আলপনা থেকে শুরু করে বিয়ে- সব জায়গায় এই একই জিনিস। এটা তো ঠিক নয়। গ্রামবাংলায় গেলে দেখা যাবে, অন্যান্য দেবীর পুজোর ক্ষেত্রেও পদচিহ্নের প্রচলন রয়েছে; এবং তা লক্ষ্মীর ছাপের সঙ্গে আলাদা। বীরভূমে গেলে দেখা যাবে, ওখানে কিছু গ্রামে সরস্বতী পুজোয় দেবীর পায়ের চিহ্ন আঁকা হয় অন্যরকমভাবে। সেটাই প্রাচীন সময় থেকে চলে আসছে। চণ্ডীর পা’ও আলাদা। আর একই কথা প্রযোজ্য আলপনার ক্ষেত্রেও। এই আঁকার ক্ষেত্রেও তো অনেক নিয়ম আছে, নীতি আছে। সেসব কি মনে রেখেছি আমরা? এখন তো রেডিমেড স্টিকারও বেরিয়ে গেছে। কিছু না জেনেই সেসব ব্যবহার করছি। মাঝখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার আলপনার ঐতিহ্য।” 

আলপনা নিয়ে কথা হচ্ছে, আর তার তৈরির উপকরণ আসবে না তা কি হয়! কেউ খড়িমাটি দিয়ে, কেউ বা চক, চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করে মণ্ড। তারপর সেই মণ্ডই হয়ে ওঠে আসল জিনিস। এখানেও সময়ের আঘাত এসে লেগেছে বলে জানান রবিবাবু। একটা সময় শুধুমাত্র চালের গুঁড়ো দিয়েই আলপনা আঁকা হত। আর অন্য কিছু মিশত না সেখানে। তাও যে সে চাল নয়, সদ্য ঢেঁকি ছাঁটা চালের গুঁড়ো জলে গুলেই তৈরি হত আলপনা। কালের নিয়মে ঢেঁকি বিদায় নিয়েছে; তার জায়গায় এসেছে শিলনোড়া, হামানদিস্তা। পরে সেই চালের গুঁড়োরই দোসর হল খড়িমাটি। সাদা আলপনায় ভরে যেত ঘর। এখন সেই রাস্তায় জায়গা করে নিয়েছে চক এবং স্টিকার। নিয়ম বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছি আমরাও। তবুও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার দায়ও আমাদেরই। লক্ষ্মীপুজো, আলপনা, পাঁচালি সেই আবহমান সময়েরই অঙ্গ। ঘরে ঘরে ভরে উঠুক ধনসম্পদ। আসুক আনন্দ। যাতে প্রতি পূর্ণিমার রাতে ঘরে ঘরে লক্ষ্মী ঠাকরুন উঁকি দিয়ে দেখবেন একরাশ হাসিমুখ… 

তথ্যঋণ-
১) রবি বিশ্বাস, গবেষক
২) ‘বাংলার ব্রত’/ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছবি – রবি বিশ্বাস

আরও পড়ুন
মহানায়কের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো; ৭০ বছর ধরে একই পরিবারের হাতে তৈরি প্রতিমা

Powered by Froala Editor

More From Author See More