সাম্প্রতিক সময়ে বারবার দেখা গেছে কোনো কিছু পছন্দ না হলেই সমাজমাধ্যমে উঠছে ‘বয়কট’-এর (Boycott) ধুয়ো। তা সে সিনেমা নিয়ে হোক কিংবা কোনো বিশেষ ব্যক্তি নিয়ে। ইতিহাসের পাতাতে শক্তিশালী আন্দোলনের রূপ নিয়েছে ‘বয়কট’। ইংরেজ আমলে বিদেশি পণ্যের বিরুদ্ধেও ছিল ‘বয়কট’-এর ডাক। শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও যথেষ্ট জনপ্রিয় শব্দটি। মজার বিষয় হল, উদ্দেশ্য এক থাকলেও এই শব্দের আবির্ভাব হয়েছিল এক বিশেষ ব্যক্তির সৌজন্যে। যাঁর নাম ছিল চার্লস কানিংহাম বয়কট (Charles Cunningham Boycott)।
যাঁর জন্ম ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে। প্রথমে অবশ্য তাঁর নামের শেষ অংশটি ছিল ‘বয়কাট’ (Boycatt)। কিন্তু ৯ বছর বয়সে পরিবার থেকে নামবদল করে রাখা হয় ‘বয়কট’। কারণটা অবশ্য কেউ জানে না, তবে এই পরিবর্তন দেখে নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছিলেন ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দুরন্ত ও মেধাবী বালক চার্লসের প্রথম ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার। সেই অনুযায়ী ১৮৪৮ সালে তাঁকে ভর্তিও করা হয় উলউইচের ‘রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমি’-তে। কিন্তু কিছু বিশেষ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় অপূর্ণ রয়ে গেল সেনাবাহিনীর স্বপ্ন। জীবন বয়ে গেল অন্যখাতে। সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে শুরু করলেন জমি কেনাবেচার কাজ।
যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান তিনি। অর্থের অভাব ছিল না পরিবারে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে কিনে ফেললেন মায়ো কাউন্টির অন্তর্গত আচিল দ্বীপের বেশ খানিকটা জমি। পাশাপাশি কাজ করতে লাগলেন আয়ারল্যান্ডের আর্ল অফ আর্নের জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। আর্নের অধীনে তখন প্রায় ৪০০০০ একর জমি। বয়কটের দায়িত্ব ছিল এই বিশাল পরিমাণ জমি দেখভাল, সেখানকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করা এবং অনাদায়ে তাদের উচ্ছেদ করা। অনেকটা জমিদারের নায়েবের মতো। আর এই কাজে প্রচণ্ড নৃশংস ছিলেন বয়কট। তিনি বিশ্বাস করতেন, জমি ও চাষির জীবনের সমস্ত স্বত্ব মালিকের। ফলে যেভাবেই হোক প্রাপ্য আদায় করতে হবে। তাতে কিছু মানুষের ক্ষতি হলেও, সে দায় তাঁর নয়। এমনকি কাজে আসতে সামান্য দেরি হলে, চাষিদের মাইনে কেটে নিতেন বয়কট।
স্বাভাবিকভাবেই বয়কটের জোরজুলুমে ক্ষিপ্ত হতে থাকে চাষিরা। ১৮৭৯ নাগাদ মাইকেল ডেভিট নামের এক কৃষকসন্তান মায়ো প্রদেশে গড়ে তোলেন ‘আইরিশ ন্যাশনাল ল্যান্ড লিগ’। সারা দেশের নির্যাতিত কৃষকদের এক ছাতার তলায় আনার দায়িত্ব নেয় এই সংগঠন। খাজনা কমানো ও উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে সরগরম হয়ে ওঠে সমগ্র আয়ারল্যান্ড। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য ওঠে, তার সঙ্গে খুব তফাৎ করা যাবে না ‘লাঙল যার, জমি তার’-এর স্লোগানকে। ১৮৮০ সালে আজন্মার জন্য আর্নের অধীনস্থ কৃষকরা দাবি জানায় ২৫ শতাংশ খাজনা কমানোর। শেষ পর্যন্ত রফা হয় দশ শতাংশে। সেই অর্থ উদ্ধারে প্রবল অত্যাচার চালান বয়কট। উচ্ছেদও করা হয় বেশ কয়েকটি পরিবারকে।
আরও পড়ুন
মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে ‘লড়াই’ করতে চেয়েছিলেন যে ব্যক্তি
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় ল্যান্ড লিগের তরফ থেকে। খবর পৌঁছোয় সংসদ পর্যন্ত। সেই সময়ে সংসদের সদস্য ও ল্যান্ড লিগের পক্ষপাতী চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেল ঘোষণা করেন, এরকম ব্যক্তিকে সব জায়গায় উপেক্ষা করা উচিত। ব্যাস, যেন ঘি পড়ল আগুনে! বয়কটের বিরুদ্ধে শুরু হল সামাজিক ধর্মঘট। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হয় না, কেউ কথা বলে না তাঁর সঙ্গে। জমি কেনাবেচা বন্ধ। শুকিয়ে যেতে লাগল জমির ফসল। এমনকি পিয়ন পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে চিঠি দিতে আসতে চায় না। এ যেন সম্পূর্ণ একঘরে অবস্থা। ‘দ্য টাইমস’-এর পাতায় নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে খোলা চিঠি লিখলেন বয়কট।
আরও পড়ুন
মৃত ব্যক্তির মাথা ‘সংগ্রহ’ করতেন এই ব্যক্তি
এগিয়ে এলেন বেলফাস্ট আর ডাবলিনের বন্ধুরা। ফসল কাটার জন্য পঞ্চাশ জন লোক পাঠানো হল মায়োতে। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য রইল ৯০০ সশস্ত্র সৈন্য। তাতে অবশ্য লাভ কিছু হয়নি বয়কটের। ৩৫০ পাউন্ডের ফসলের বদলে সৈন্যবাহিনীর জন্য তাঁর খরচ হয়েছিল ১০০০০ পাউন্ড। আর এইসব ঘটনার ফলে শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর গল্প। খবরের কাগজে জন্ম হয় অসংখ্য কার্টুনের। উনিশ শতকের শেষ দিকে ল্যান্ড লিগ ও পার্নেলের জনপ্রিয়তার ফলে যেখানেই জমিদার শ্রেণিরা অত্যাচার করত, সেখানেই নেওয়া হতে থাকে বয়কটের পদ্ধতি।
তবে আজকের অর্থে ‘বয়কট’ শব্দটির প্রয়োগ ঠিক কবে, কীভাবে শুরু হল বলা মুশকিল। অনেক গবেষকের মতে মায়োর গির্জার পুরোহিত ফাদার ও’ম্যালের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয় ‘বয়কটিং’ শব্দটি। বয়কটের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা আগে ইংল্যান্ডের কোথাও দেখা যায়নি। ফলে এই নতুন পথ থেকেই জন্ম হয়েছিল এক আনকোরা শব্দের। কিছুদিনের মধ্যেই যা ছড়িয়ে পড়ে লন্ডনের সংবাদপত্রগুলিতে। ১৮৮৮-তে ঠাঁই মেলে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতেও।
এদিকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন বয়কট। এমনকি নিজের পরিচয় দিতে লাগলেন শুধু চার্লস কানিংহাম বলে। কিছুদিন সাফোকে কাজ করার পর বাঁচার জন্য চলে যান আমেরিকাতে। ভেবেছিলেন এই নামে হয়তো কেউ চিনতে পারবে না তাঁকে। কিন্তু নিউইয়র্ক ট্রিবিউনের মতো পত্রিকা ফের মনে করিয়ে দিল তাঁর অতীত ইতিহাস ও নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঘটনাকে। অবশেষে ১৮৯৭ সালে মৃত্যু ঘটে বয়কটের। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আজও অমর হয়ে রয়েছে তাঁর নাম।
Powered by Froala Editor