অন্ধকার একটা টানেল। স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালের বেশ কিছু জায়গায় শ্যাওলা জমেছে। টানেলের ভেতরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় জল পড়ার আওয়াজ। কিছু ‘অন্য’ আওয়াজও কানে আসে। এটা কোনো হলিউডের ভূতের সিনেমার প্লট নয়। ভারতের বুকেই রয়েছে এমন একটি ‘ভূতুড়ে’ টানেল, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি। সেই সঙ্গে জড়িত আছেন একজন ‘ব্যর্থ’ ইঞ্জিনিয়ার, যাকে নাকি আজও ‘ঘুরে বেড়াতে’ দেখা যায় এই বারোগ টানেল চত্বরে।
ভারতের হিমাচল প্রদেশের অন্যতম বিখ্যাত রেলওয়ে হল কালকা-সিমলা রেলওয়ে। ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকার অন্তর্গত এই রেলওয়ে জুড়ে রয়েছে ১০২টি টানেল। আগে অবশ্য এর সংখ্যা ছিল ১০৭। প্রকৃতির কোনও ক্ষতি না করে, তার সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই যে উন্নয়ন সম্ভব, প্রায় ১০০ বছর আগে সেটাই দেখিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা। চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে ঝলমল করছে পাহাড়ি ফুল, সবুজ গাছ। তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন… পোস্টকার্ডের দৃশ্যের মতো মনে হয় না!
এই হেরিটেজ রেলওয়েরই একটি অংশ বারোগ টানেল। কালকা-সিমলার সবচেয়ে লম্বা এই টানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.১৪ কিমি। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সবথেকে স্ট্রেট টানেলও এটিই। এখানকার সব টানেলই ১৯০০ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে তৈরি হয়। নানা ইতিহাস, নানা ঘটনার সাক্ষী থেকেছে এই বারোগ স্টেশন। সাক্ষী থেকেছে এই টানেলও। সবথেকে বেশি জড়িয়ে আছেন কলোনেল বারোগ, যে ব্রিটিশ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারের নামে এই স্টেশন ও টানেলের নামকরণ করা হয়। কিন্তু সেই কাহিনি ব্যর্থতার কাহিনি, হেরে যাওয়ার কাহিনি।
আগে এই টানেলগুলোকে এক একটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হত। সেই হিসেবে বারোগ টানেলের ক্রমাঙ্ক ৩৩। টানেল তৈরির মূল তত্ত্বাবধানে ছিলেন কর্নেল বারোগ। পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করার সময় একটি উপায় বার করেছিলেন তিনি। তাঁর কর্মীদের দুইভাগে ভাগ করে পাহাড়ের দু’দিক দিয়ে পাথর কাটতে বলেছিলেন। অঙ্ক কষে, বিস্তর হিসেব করে জায়গা বেছেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, এইভাবে দু’দিকে খুঁড়তে খুঁড়তে একসময় মাঝখানে এসে জুড়ে যাবে ব্যাপারটা। তৈরি হয়ে যাবে সুড়ঙ্গ।
কিন্তু হিসেবে সামান্য ভুল হয়েছিল। ফলস্বরূপ, রাস্তা এক জায়গায় এসে মিলল না। কর্মীরা তো বুঝতে পারলই, বারোগও বুঝতে পারলেন খুব বড়ো একটা ভুল হয়েছে। পুরো কাজটা ব্যর্থ হল। যথারীতি খবর পৌঁছল ব্রিটিশ সরকারের কাছে। রেল ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল বারোগকে ১ টাকা জরিমানা করা হল। এদিকে তাঁর কর্মীরাও বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। সাহেবের ভুলের জন্য এতদিনের পরিশ্রম বিফলে গেল। অবসাদে চলে গেলেন বারোগ। সমস্ত ব্যর্থতার দায় যে তাঁরই! যাবতীয় সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লেন তিনি।
একদিন নিজের পোষা কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন বারোগ। অসমাপ্ত টানেলের কাছে এসেই পকেট থেকে বের করলেন রিভলবার। তারপর নিজেকে গুলি করলেন। তাঁর কুকুরটা ভয় পেয়ে গ্রামে চলে গেল। যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, ততক্ষণে প্রাণ বেরিয়ে গেছে কলোনেল বারোগের। এমন অপমানের দায় নিয়ে বাঁচতে চাননি তিনি।
তারপর ১৯০৩ সালে টানেল নং ৩৩-এর কাজ শেষ করেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার এইচ এস হ্যারিংটন। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন এক ভারতীয় সাধু, বাবা ভালকু। তবে কর্নেল বারোগকে স্মরণে রাখতেই এই স্টেশন চত্বর ও এই টানেলের নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তাঁকে। এখানেই সমাহিত করা হয় তাঁকে। তারপর, ইতিহাস এগিয়েছে নিজের মতো। কত লোকে এসেছে, গেছে। কিন্তু লোকের বিশ্বাস, একজন এখনও এই টানেলের চারপাশে রয়েছেন। তিনি, প্রয়াত বারোগ!
এই টানেলের ভেতর ঘণ্টায় ২৫ কিমি স্পিডে চলে ট্রেন। পেরোতে সময় লাগে আড়াই মিনিট মতো। এই সময়তে অনেকেই নাকি ‘কিছু’ দেখেছেন। টানেলের ভেতর ঢুকলে, নিস্তব্ধতা ভেদ করে আসে ফিসফিস আওয়াজ। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, টানেলের মায়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি বারোগ সাহেব। তাই এখনও রয়ে গেছেন এখানে। ঘুরে বেড়ান…
‘ভূত’ সত্যিই আছে কিনা, সেটা তো তর্কের বিষয়। কিন্তু টানেলের ইতিহাস, তার চেহারা দেখলে একটা গা ছমছমে ব্যাপার আসে তা তো বলাই বাহুল্য। ঐতিহ্য, লোককথা সব একসঙ্গে মিশে গেছে এই বারোগ টানেলে। আজও যখন ট্রেন যায়, একবার সেই হেরিটেজের গায়ে নাড়া দিয়ে যায়। গাছের ফাঁক দিয়ে সেখানে নেমে আসে সূর্যের নরম আলো…