শাঁখা-সিঁদুর পরা হিন্দু ধর্মের একটি রীতি হিসেবে পরিচিত অনাদিকাল থেকেই। কিন্তু এই রীতি কি কেবলই একটি সামাজিক বিশ্বাস নয়? এর পিছনে যে বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ নেই, তাতে সন্দেহ নেই কোথাও। হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেকেই আছেন, যাঁরা এই প্রথায় বিশ্বাসী নন। তবে সম্প্রতি গুয়াহাটি হাইকোর্ট এক মহিলার উদ্দেশ্যে মন্তব্য করল, ‘শাঁখা-সিঁদুর না পরার অর্থ, বিবাহকে অস্বীকার করা।’ উচ্চ আদালতের বিচারপতির এহেন মন্তব্য ঘিরেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে শোরগোল।
বিষয়টি সূত্রপাত ২০১৩ সালে। পারিবারিক অত্যাচারের শিকার হয়ে ওই মহিলা যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে আলাদা থাকতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর স্বামী রাজি হননি তাতে। বেড়েছিল পারিবারিক অশান্তি। কিছুদিন পরে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের ওপর অত্যাচারের সঙ্গেই ছিল পণ আদায়ের অভিযোগ। উল্টোদিকে তাঁর স্বামীও তাঁর বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিলেন, বিবাহবিচ্ছেদের দাবিতে। সঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন ওই মহিলা সন্তান নিতে চান না। দুই পক্ষের মামলাকেই বাতিল করে দিয়েছিল আদালত। পরবর্তীকালে সেই মামলাই যায় গুয়াহাটি হাইকোর্টে।
কোর্টে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়ার পক্ষে ওই মহিলার স্বামী অন্যান্য কয়েকটি কারণের পাশাপাশি জানিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী শাঁখা-সিঁদুর পরতে চান না। এই বিষয়ে অস্বীকার করেননি ভদ্রমহিলা। আর তার ভিত্তিতেই সম্প্রতি এই মামলারই রায় দিলেন গুয়াহাটি হাইকোর্টের বিচারপতি অজই লাম্বা এবং সৌমিত্র সাইকিয়া।
এখন বিষয় হল, বিবাহ বিচ্ছদের রায় দেওয়ার মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এই রায়ের কারণের ওপরে। বিচারপতির এই মন্তব্যের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ। কারণ ধর্ম এবং বিশ্বাস এই দুটিই ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সেক্ষেত্রে কোনো ধর্মীয় আচারের সাপেক্ষে এই রায় দেওয়া, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে হস্তক্ষেপ নয় কি?
হিন্দু শাস্ত্রমতে ব্রহ্মপুরাণে উল্লেখিত আছে শাঁখা-সিঁদুরের কথা। তুলসী দেবী এবং শঙ্খাসুরের সেই কাহিনি অনেকেরই জানা। সিন্ধু সভ্যতাতেও শাঁখা সিঁদুরের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে লিঙ্গ নির্বিশেষেই সেখানে সিঁদুরের টিপ পরার প্রচলন ছিল। কিন্তু ইতিহাসের নানান তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই রীতির প্রচলন হয়েছে আরো অনেক পূর্বে। এই রীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য এবং বর্বরতাও।
একটা সময়, অন্যান্য পণ্যের মতই নারীদেরও পুরুষের সম্পত্তি হিসাবেই চিহ্নিত করত সমাজ। আর অধিকারের চিহ্ন হিসাবে কপালে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষত তৈরি করা হত। হাতে দেওয়া হত লোহার বেড়ি। কোমরে শিকল। যা ছিল ‘অধিকৃত’-এর সূচক। ‘নারী-লুঠ’-এর এই চিহ্নগুলিই পরবর্তীকালে সভ্যতা এগনোর সঙ্গে বদলে যায় শাঁখা-সিঁদুরে। ‘লোহা’ থেকেই আসে ‘নোয়া’ কথাটি। আবার লোহার বেড়-এর আরেক অর্থ আয়স্ত। সেখান থেকেই বিবর্তিত হয়েছে ‘এয়োস্ত্রী’। যার অর্থ বিবাহিত মহিলা।
আরও পড়ুন
প্রতিবছর বিশ্বে যৌনাঙ্গ অপসারণের শিকার অসংখ্য মহিলা, ভারতেও প্রচলিত ছিল এই ঘৃণ্য প্রথা
আবার কেউ কেউ বলেন, আদিমকালে কন্যাহরণের সময় যে যুদ্ধ হত, সেই যুদ্ধে জয়লাভকারী যুবক নিজের আঙুল কেটে রক্ত বের করে পরিয়ে দিত কন্যার সিঁথিতে। মূলত কন্যাটির ওপর নিজের অধিকার স্থাপনের জন্যেই এই রীতি। পরবর্তীকালে সেই রক্তফোঁটাই বদলে যায় সিঁদুরে। ইতিহাস ঘাঁটলে উঠে আসে এই তথ্যও।
মঙ্গলচিহ্ন বা পবিত্রতা কিংবা আয়ুবর্ধক হিসাবে এই রীতি চিহ্নিত করে এলেও এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকারবোধ এবং বীরত্বের ছদ্মপ্রতীক। সিঁদুর-শাঁখা সেই অধিকারবোধেরই সূচক। সে কারণেই হয়তো নারীদের জন্য এমন রীতির প্রচলন থাকলেও পুরুষদের জন্য তা নেই।
একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে যখন গোটা দেশ নারী অধিকারের জন্য সরব হচ্ছে। সরকারের কথায় বার বার উঠে আসছে ‘মহিলা ক্ষমতায়ন’-এর কথা। ঠিক সেই মুহূর্তেই উচ্চ আদালতের এই মন্তব্য। এর আগেও এক ধর্ষিতার দিকে আদালত প্রশ্ন তুলেছিল। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল রাত্রে কাজে যাওয়া, পোশাক এবং মাদকাসক্তি নিয়ে। আইনের মধ্যে দিয়েই কোথাও প্রকট হয়ে উঠেছিল লিঙ্গ বৈষম্য। এবারো আদালতের রায়ের মধ্যে সেই ধাঁচই কি ফুটে উঠল? ক্রমেই আমরা কি ফিরে যাচ্ছি আদিমযুগের কঠিন পুরুষতন্ত্রের কাছে? জানা নেই। এই প্রশ্ন তোলা থাক পাঠকদের জন্যই।
আরও পড়ুন
২০০ বছর আগেও ক্রীতদাস প্রথা বহাল ছিল কলকাতায়, গোলাম কেনা হত আফ্রিকা থেকে
তথ্যঋণ -
ভোলগা থেকে গঙ্গা - রাহুল সাংকৃত্যায়ন
বিয়ের শব্দকোষ - হরিপদ ভৌমিক
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor