দূর থেকে মনে হবে যেন কয়েকশো দেশলাই কাঠি সাজানো রয়েছে অদ্ভুত কায়দায়। ভুল ভাঙবে অবশ্য কাছে গেলে। দেশলাই কাঠি নয়, একটা আস্ত সেতু তৈরি করা হয়েছে সরু বাঁশ দিয়ে। এ আর নতুন কী? নদীমাতৃক বাংলার খালে-বিলে তো হামেশাই দেখা যায় এই দৃশ্য। কিন্তু কাম্বোডিয়ার (Cambodia) এই সেতুটি বিশ্বের দীর্ঘতম বাঁশের সেতু। যা তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। এবং প্রতিবছর এক বিশেষ সময়ে ভেঙে ফেলা হয় সেটি। আবার গড়ে ওঠে পরের বছর। অনেকটা যেন পুজোর প্যান্ডেলের মতো। শুধু যাতায়াতের জন্য নয়, স্থানীয় মানুষের অর্থনীতিও নির্ভর করে আছে এর উপরে।
মেকং (Mekong) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘতম নদী। সমগ্র এশিয়ার মধ্যে দৈর্ঘ্যে তৃতীয়। প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত নদীটি ছুঁয়ে গেছে মায়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া আর ভিয়েতনামের দক্ষিণ অংশকে। বর্ষার সময়ে অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে ওঠে নদীর স্রোত। ভাসিয়ে দেয় বহু অঞ্চলকে। কাম্বোডিয়ার ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর ক্যাম্পং চ্যামের (Kampong Cham) আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চলও পড়ে সেই আওতায়। যেমন দেশের পূর্ব দিকের কোহ পেন (Koh Pen) দ্বীপটি। মেকং নদীর মাঝেই জেগে উঠেছে আস্ত চর। আর তার সঙ্গে ক্যাম্পং চ্যামের যোগসূত্র রক্ষার একমাত্র দায়িত্ব প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁশের সেতুটির (Bamboo Bridge)।
প্রতিবছর বর্ষার পর মেকংয়ের জলস্তর নামতে শুরু করলেই শুরু হয় নতুন আয়োজন। তখন নদীতে প্রায় জল থাকে না বললেই চলে। কোনো কাজে লাগে না ফেরি ব্যবস্থাও। সেই সময়ে অসংখ্য সরু বাঁশ লম্বালম্বিভাবে পুঁতে দেওয়া হয় নদীর ক্লেদাক্ত গর্ভে। কিছু বাঁশ থাকে আড়াআড়িভাবে। তার উপর বাঁধা হয় সেতুর পাটাতন। মোট কথা, এই পলকা বাঁশের কেরামতিতেই ঝড় কিংবা নদীর স্রোত কোনোভাবেই ক্ষতি করতে পারবে না তার। আবার বর্ষা এলেই জেগে ওঠে মেকং নদী। জলরাশি আছড়ে পড়ে সেতুর উপরে। তখন পুরো সেতুটি খুলে ফেলে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাঁশগুলি। ফেরিই তখন একমাত্র ভরসা।
বাঁশের সেতুর উপর দিয়ে পথচারী ছাড়াও অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে বাইক আর সাইকেল। এমনকি চারচাকা গাড়িও। কিন্তু খুঁটি ডুবে রয়েছে কাদামাটিতে, ফলে একটু চাপ পড়তেই কেঁপে ওঠে সেতুটি। নদীর জল ছিটকে এসে পিচ্ছিল করে দেয় উপরের অংশ। অনভ্যস্ত মানুষের পক্ষে তখন মুশকিল হয়ে ওঠে ভারসাম্য বজায় রাখা। নদীর ঢেউতে দুলতে দুলতে কোনো রকমে অন্য পারে পৌঁছোনো যেন এক আলাদাই কসরত। আর সেটাকেই হাতিয়ার করেছে স্থানীয় লোকেরা। এই অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা নিতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এসে উপস্থিত হয় মেকং নদীর ধারে। কিন্তু সেতুতে হাঁটার জন্য রীতিমতো টাকা খরচ করতে হয় তাদের। দেশীয় লোকেদের জন্য মাথাপিছু ভাড়া ১০০ রিয়েল, ভারতীয় মুদ্রায় পড়বে মাত্র দুটাকা। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে নেওয়া হবে তার চল্লিশ গুণ অর্থ। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি বাইক ইচ্ছাকৃত পাশ দিয়ে চলে গিয়ে বাড়িয়ে দেবে সেতু পেরোবার মজা। সে হিসেবে তাদের প্রাত্যহিক আয় হয় কুড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। স্থানীয়দের অবশ্য যুক্তি যে, প্রতি বছর ব্রিজ তৈরি করতে খরচ পড়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। সরকারি সাহায্য আসে যৎসামান্য। তাই নিজেরাই তৈরি করেছেন এই ব্যবস্থা। বাঁশের তৈরি প্যান্ডেলের মতো রাস্তা পেরোবার জন্য টাকা দেওয়ার ব্যবস্থাটিও সম্ভবত বাঙালির কাছে একেবারে অচেনা নয়।
আরও পড়ুন
গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি সেতু, মেঘালয়ের অনন্য বিস্ময়
তবে এবার শেষ হতে চলেছে পঞ্চাশ বছর পুরনো সেতুর প্রয়োজনীয়তা। এর দুই কিলোমিটার দক্ষিণে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক সেতু। প্রায় তিরিশ টনের কাছাকাছি হবে তার বহনক্ষমতা। কোনো টাকাও লাগবে না পার হওয়ার জন্য। ফলে কারোর পৌষ মাস, কারোর সর্বনাশ। নিত্যযাত্রীদের কাছে সুখবর হলেও, দুশ্চিন্তার ভাঁজ দ্বীপবাসীর কপালে। বিপদের মুখে তাদের অর্থনীতি। এখনও অবশ্য তারা আশায় যে পর্যটকরা নিশ্চয়ই আসবেন এখানে। কিন্তু ভাড়া কি কমাবেন স্থানীয়রা? সেই উত্তর কিন্তু মেলেনি।
আরও পড়ুন
৬০০০ বছরেও অটুট! কেন তৈরি হয়েছিল এই সেতু?
Powered by Froala Editor