আসাম-মিজোরাম সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, দায়ী ব্রিটিশ বিভাজনই?

গতকাল থেকেই উত্তপ্ত আসাম-মিজোরাম সীমান্ত। হ্যাঁ, একই দেশের দুই রাজ্যের মধ্যে শুর হয়েছে যুদ্ধ। একদিকে প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মিজোরাম। অন্যদিকে তিনটি জেলার ১৬৫ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে রুখে দাঁড়িয়েছে আসাম পুলিশ। সংঘর্ষে আসাম পুলিশের অন্তত ৬ জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। আহত ২০ জনেরও বেশি। কিন্তু এর কারণ কী? উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে।

সময়টা ১৯৩৩। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তখন নতুন করে চলছে ভারত শাসন আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া। এবার দেশের নেটিভ নেতাদের নিয়ে গড়ে উঠবে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু তার আগে প্রতিটা রাজ্যের সঠিক মানচিত্রের প্রয়োজন। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলের রাজ্যগুলোর বিভাজনরেখা যে একেবারেই স্পষ্ট নয়। ঠিক এই সময় আসাম এবং মিজোরামের মধ্যে একটি বিভাজনরেখা তৈরি করা হল। তখন অবশ্য এর নাম আসাম এবং মিজোরাম ছিল না। বিভাজনরেখা টানা হল চাচর সমতল অঞ্চল এবং লুসাই পার্বত্য অঞ্চলের মাঝে। আর সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই।

চাচর ও লুসাইয়ের অবশ্য নতুন করে কোনো বিভাজনরেখার প্রয়োজন ছিল না। উত্তর-পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলা থেকে আলাদা করতে ১৮৭৩ সালেই আইন তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। আর সেই আইন অনুযায়ী ১৮৭৫ সালে স্পষ্ট বিভাজনরেখা স্থির করা হয়। শুধুই ভূ-প্রকৃতি নয়, এই বিভাজনের সময় মাথায় রাখা হয়েছিল দুই জনজাতির পৃথক ইতিহাসের দিকটিও। কিন্তু ১৯৩৩ সালে মণিপুর রাজ্যটির সীমানা স্থির করা প্রয়োজন ছিল। আর এর ফলেই বদলে গেল লুসাইয়ের মানচিত্র। তখনও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল মিজো জনজাতির মধ্যে। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ শাসকদের কাছে সবই হার মেনেছে। আর দেশের জাতীয় নেতারা তখন স্বরাজ ছাড়া অন্য কিছু নিয়েই যে মাথা ঘামাতে প্রস্তুত নন। ফলে পাহাড়ের কিছু আদিবাসী মানুষের দাবি চাপা পড়ে যেতে সময় লাগেনি।

ক্রমে দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু উত্তর-পূর্বের সীমান্ত সমস্যার সমাধান হল না। আজকের আসাম, মণিপুর, মিজোরাম সব নিয়েই তৈরি হল বিরাট আসাম রাজ্য। যদিও সেখানে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণ শূন্য বললেও চলে। সবটাই তখনও পরিচালনা করেন উপজাতির স্থানীয় মুরুব্বিরা। তবে মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির বেশ কিছু খ্রিস্টান মিশনারীর উদ্যোগে চালু হয়েছে স্কুল। সেখানে মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডির আদর্শের কথা পড়ানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে এতদিনের পুরনো সমাজব্যবস্থায় বদলের প্রয়োজন অনুভব করলেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা। ষাটের দশকে স্থানীয় মুরুব্বিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠল। আর এই আন্দোলনে সমর্থন জানাল খোদ ভারত সরকার। কারণ সরকারের উদ্দেশ্য পাহাড়ে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

মুরুব্বিদের দিন শেষ হল। কিন্তু উপজাতির মানুষদের দাবি, নতুন করে রাজ্য পুণর্গঠন করতে হবে। ১৯৭২ সালে জন্ম নিল মিজোরাম এবং মণিপুর। অবশ্য প্রথমে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে অঙ্গরাজ্যের তকমা পায় মিজোরাম। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই কালপর্বে একবারও সীমান্তরেখা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। পুরনো সমাজব্যবস্থা ছেড়ে এসে আধুনিকতার জোয়ারেই গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সবাই। প্রশ্ন উঠল ১৯৯৫ সালে। চাচর এবং লুসাই পাহাড়ের সীমান্তরেখা নিয়ে আপত্তি জানালেন মিজো উপজাতির মানুষরা। আর আবারও ফিরে তাকাতে হল ১০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ইতিহাসের দিকে। ১৮৭৫ সাল, যেবছর প্রথম বিভাজনরেখা স্থির করা হয়। সেই একবারই মিজো উপজাতির মানুষদের নিজস্ব মতামত নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এরপর ১৯৩৩ সালেও কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পরেও না। কিন্তু সীমান্তরেখা বদলেছে বারবার। মিজো উপজাতির মানুষদের দাবি, বর্তমানে চাচর জেলার মধ্যে  অবস্থির ১৩১৮ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল ছিল তাঁদের বাসস্থান। সমতলের মানুষরা তাঁদের রীতিমতো সরিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করেছেন।

আসাম-মিজোরাম সীমান্ত সমস্যা নতুন নয়। গত ২৫ বছর ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলেছে। মামলা চলেছে সুপ্রিম কোর্টেও। ২০০৫ সালে আদালত নতুন করে সীমান্ত পুণর্গঠনের নির্দেশ দেয়। কেন্দ্রকে এই নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করতেও বলা হয়। কিন্তু আজও সেই কমিটি তৈরি হয়নি। অন্যদিকে মিজোরাম রাজ্য সরকার নিজের মতো করে তৈরি করেছে কমিটি। বহু প্রাচীন সমস্ত মানচিত্র জোগাড় করে তাঁরা প্রমাণ করেছেন, চাচর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল আসলে লুসাই পাহাড়েরই অংশ। এই বিতর্কেরই ফলশ্রুতি বর্তমানের সীমান্ত সংঘর্ষ। কিন্তু এই ২৫ বছরের মধ্যে কি শান্তিপূর্ণ মীমাংসার কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যেত না? প্রশ্ন উঠবেই।

Powered by Froala Editor