ভেনিসের প্রদর্শশালায় সেদিন এক ভয়াবহ পরিবেশ। ছবির প্রদর্শনী দেখতে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। কেউ আবার রীতিমতো বমি করতে করতে বেরিয়ে আসছেন। আর হবে নাই বা কেন? শিল্পী নিজেই তৈরি করেছিলেন এই পরিস্থিতি।
দেয়ালে টাঙানো ক্যানভাস নয়, বরং প্রদর্শনীশালার দেয়ালগুলোকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁর শিল্পের জন্য। আর সেখানে নির্বিচারে ছড়িয়েছেন শুধু লাল রং। যেন কসাইখানার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে রক্ত (Blood)। আর এই কসাইখানার শ্রষ্টা হারম্যান নিচ (Hermann Nitsch) তখন প্রদর্শশালার ছাদে বসে হাসছেন। ১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল এমনই এক ইতিহাস গড়েছিলেন হারম্যান নিচ। জীবনের অসংখ্য ভয়ঙ্কর এবং রক্তাক্ত শিল্পকর্মের মধ্যে সেটাই ছিল শেষ। এরপর অবশ্য আর রং-তুলি-ক্যানভাসের বাইরে ছবি আঁকেননি তিনি। সেই ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর ২৫ বছর পূর্তির ঠিক আগের দিন, গত ১৮ এপ্রিল ভিয়েনা শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শিল্পী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
হারম্যান নিচ, ৬০-এর দশকের ইউরোপীয় শিল্পীদের কথা উঠলে যাঁর কথা না উঠে উপায় নেই। সময়টাই এমন, শিল্পের প্রতিটা ধারায় তখন চলছে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা। সবচেয়ে বড়ো কথা, শিল্পের ভিতর দিয়ে তখন এক রাজনীতির খোঁজ চলছিল। যে রাজনীতিতে গঠনমূলক বিকল্পের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ, হতাশা আর গ্লানি। ভিয়েতনামের যুদ্ধ এই সমস্তকিছুকেই নিয়ে গিয়েছিল চরম পর্যায়ে। ইউরোপ এবং আমেরিকার শিল্পীদের হাতে তখন এক পৃথক শৈলীর জন্ম হচ্ছিল। শিল্পীরা যাকে বলতেন ‘অ্যাকশন’ নির্ভর শিল্পকর্ম। অর্থাৎ ছবি আঁকা হয়ে উঠেছিল এক সক্রিয় যাপনের অংশ।
এই অ্যাকশন যে সবসময় ভয়াবহ, হিংস্র হয়ে উঠেছিল, এমন নয়। কেউ নিজের ছাদ পরিষ্কার করেছেন, কেউ বাগানের আগাছা নিড়িয়েছেন। আর এই সমস্তকিছুকেই এক জীবন্ত শিল্পকর্ম হিসাবে তুলে ধরেছেন। তবে হারম্যান নিচ যেন মানুষের মনের গভীরের হিংসাকেই বারবার উস্কে দিতে চেয়েছেন। প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, সভ্য মানুষের মনের গভীরের পাশবিকতাকে তুলে ধরাই তাঁর কাজ। আর সেই কাজের বলি হয়েছে অসংখ্য পশু। আক্ষরিক অর্থেই। কখনও কয়েক ডজন ভেড়ার চামড়া খুলে নিয়ে তাদের ঝুলিয়ে দিয়েছেন একটি ক্রুস আকৃতির কাঠের দণ্ডে। কখনও আবার একটিমাত্র ভেড়ার মাথা হয়ে উঠেছে তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তু। একেবারে দর্শকদের চোখের সামনে সেইসব পশুদের হত্যা করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
শিল্পী ও তারকার দ্বন্দ্বে বাঙ্ময় সৌমিত্র-'অভিযান'
ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লেগেছিলই। পশুপ্রেমীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন হারম্যানের উপর। তবে তার চেয়েও বেশি করে আঘাত পেয়েছিল মানুষের সহজাত সৌন্দর্যবোধ। হারম্যান এবং তাঁর সতীর্থদের এই হিংস্রতাকে শিল্পের তকমা দিতে কুণ্ঠিত হয়েছিলেন সকলেই। এমনকি শিল্পের নামে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে বেশ কয়েকবার জেলেও যেতে হয়েছে তাঁকে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর প্রদর্শনী। অথচ এই একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে একের পর এক দেশে যুদ্ধের নামে, দেশপ্রেমের নামে চলেছে মৃত্যুমিছিল।
আরও পড়ুন
আদিবাসী চিত্রকলাকে রক্ষা করতে মহিলা শিল্পীদের সংগঠন হাজারিবাগে
শেষ পর্যন্ত ‘অ্যাকশন’ নির্ভর ছবি থেকে সরে এসেছিলেন হারম্যান। অবশ্য ছবির বিষয়বস্তু থেকে হিংস্রতাকে সরিয়ে ফেলতে পারেননি। সেইসব ছবিগুলো শিল্পের জগতে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে বলেও মনে করেন চিত্রসমালোচকরা। তবে তাঁর প্রথমদিকের বিতর্কিত অধ্যায়ও যে শুধু নিন্দিতই হয়েছে, এমনটা বললে ভুল হবে। পারফর্মিং আর্টের ধারার অন্যতম প্রাণপুরুষ বলে মনে করা হয় হারম্যান নিচকে। এমনকি অস্ট্রিয়ায় তাঁর নামে মিউজিয়ামও রয়েছে। হয়তো বিতর্কই শিল্পীদের কিংবদন্তি করে তোলে। হারম্যান নিচের জীবনও তাই প্রমাণ করে যায়।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ শিল্পীর আঁকা ছবির ‘প্রদর্শনী’ চাঁদে
Powered by Froala Editor