জীবনে একটিও ছবি বিক্রি করেননি তিনি। অথচ যখন মারা গিয়েছেন, তখন অন্তত ১০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক তিনি। তাঁর নাম বরিস লুরি (Boris Lurie)। বোঝাই যায়, ছবি আঁকা তাঁর কাছে কখনোই পেশাগত দিক ছিল না। অথচ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছবি আঁকা ছাড়তে পারেননি। ইতিহাসে তিনি শিল্পী হিসাবেই থেকে যাবেন। অবশ্য তিনি যে শখের আঁকিয়ে ছিলেন, তাও নয়। ছবি আঁকা ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) সময় নাৎসি অত্যাচারের যে ভয়াবহ দৃশ্যগুলি বুকের মধ্যে বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন, তাদেরই রেখায়-রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যানভাসে। আর এবার বরিস লুরির ছবি প্রদর্শিত হতে চলেছে ম্যানহাটনের মিউজিয়াম অফ জিউ হেরিটেজে (Museum Of Jewish Heritage)।
১৯২৪ সালে রাশিয়ার লেনিনগ্রাদে জন্ম হয় লুরির। তবে তাঁর যখন বছর দুয়েক বয়স, তখনই বাবা-মা চলে আসেন লাটাভিয়ার রিগা শহরে। শৈশব জীবন বেশ হাসিখুশিই কেটেছে। কিন্তু বয়স যখন সবে ১৬, তখনই লাটাভিয়ার দখল নিয়ে নেয় নাৎসি বাহিনী। লুরিদের পরিবার ইহুদি। তাই প্রত্যেককেই বন্দি করে নাৎসিরা। রিগা শহরের ঘেটোতে কিছুদিন থাকার পর তাঁর মা, ঠাকুমা ও পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে যাওয়া হয় রামবুলা ফরেস্টে। সেখানে পরপর দাঁড় করিয়ে অন্তত ২৫ হাজার মহিলাকে মেরে ফেলে হিটলারের বাহিনী। আর এই নারকীয় ঘটনা চোখের সামনে দেখেছিলেন বরিস লুরি। তবে রিগা ঘেটোতে বেশিদিন থাকতে হয়নি বরিসকে। বাবার সঙ্গে তরুণ বরিসের ঠাঁই হয় সালাসপিলস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখান থেকে নানা কারখানায় শ্রমিক হিসাবে নিয়ে যাওয়া হত তাঁদের। বিনা পারিশ্রমিকের শ্রমিক। বদলে মিলত শুধুই অত্যাচার। সালাসপিলস থেকে কিছুদিন পর নিয়ে যাওয়া হয় বিসেনওয়ালদ ক্যাম্পে।
এই বুসেনওয়ালদ ক্যাম্পে থাকার সময়েই সেখানে মার্কিন বাহিনী হানা দেয়। নাৎসি কবল থেকে মুক্ত হয়ে আমেরিকায় চলে যান বরিস লুরি। তখন ১৯৪৬ সাল। নিউ ইয়র্ক শহরে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন। কিন্তু নিজে থাকতেন সেই ভাঙাচোরা একটা কুটিরে। আর সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্টুডিও। তিনি নিজে সেই ঘরকে বলতেন নিউ ইয়র্কের বুকে এক টুকরো নাৎসি ঘেটো। তাঁর অনেক ছবি স্কেচবুকের পাতায় অসম্পূর্ণ রেখাচিত্র হয়েই থেকে গিয়েছে। আবার ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ রূপও পেয়েছে অনেক ছবি। প্রায় সব ছবিতেই প্রেক্ষাপট হিসাবে উঠে এসেছে হলোকাস্টের ঘটনা। এর মধ্যে তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে একাধিক পরাবাস্তব ছবিও। সেখানে নাৎসি সেনাদের চেহারাই হয়ে উঠেছে দৈত্যের মতো। আবার বন্দি মানুষগুলোও যেন আর ঠিক মানুষ নেই। বাস্তবিকই মানুষের চোখকে আরাম দেওয়ার জন্য ছবি আঁকেননি তিনি। আর তাই ৬০-এর দশকে তাঁর হাত দিয়ে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার নাম ছিল নো-আর্ট।
২০০৮ সালে মৃত্যু হয় বরিস লুরির। আর তারপরই তাঁর স্মৃতিতে গড়ে ওঠে বরিস লুরি আর্ট ফাউন্ডেশন। এই সংস্থার উদ্যোগেই এবার তাঁর ২৪টিরও বেশি ছবি প্রদর্শিত হতে চলেছে মিউজিয়াম অফ জিউ হেরিটেজে। প্রসঙ্গত, এই প্রদর্শশালার ২৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সেখানে কোনো সমকালীন ছবির প্রদর্শনী হতে চলেছে। এই প্রদর্শনীতে বেশিরভাগ ছবিই থাকবে বরিসের ১৯৪৬ সালের কাজগুলির মধ্যে থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতিই কীভাবে একজন বন্দিকে শিল্পী করে তুলেছিল, তার জ্বলন্ত সাক্ষী এই ছবিগুলিই।
আরও পড়ুন
টাকা নিয়েও পাঠালেন ‘ফাঁকা ফ্রেম’, অভিনব প্রতিবাদ ড্যানিশ শিল্পীর
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ফেলুদা-কাহিনির চরিত্রগুলির স্কেচ এঁকে ভাইরাল কলকাতার শিল্পী