ভাষা শুধু মানুষে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমই নয়। স্যাপিয়ার-ওয়ার্প হাইপথেসিস অন্তত সেই কথাই বলে। যে জাতির ভাষা যত উন্নত, সেই জাতির চিন্তার দক্ষতাও তত উন্নত। কিন্তু ভাষা তো আর একদিনে উন্নত হয়ে ওঠে না। তার পিছনে হাজার হাজার বছরের গড়ে ওঠা থাকে। ফলে সেখানে সাম্য আনাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে এমনই এক অদ্ভুত উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন এক মেক্সিকান-আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী, জোন কুইজাদা (John Quijada)। সে আজ থেকে ৪৪ বছর আগের কথা। আর এভাবেই জন্ম নিল পৃথিবীর জটিলতম ভাষা, ইতকুইল। আধুনিক যুগে মানুষের ব্যবহারের জন্য সম্ভবত একমাত্র কৃত্রিম ভাষা (Artificial Language)।
দেখতে দেখতে ৪ দশক পেরিয়ে গিয়েছে। ইতকুইল ভাষাতেও নানারকম বিবর্তন এসেছে। বহুবার তার ব্যাকরণ বদল করা হয়েছে। অন্তত ৪টি সম্পূর্ণ নতুন ব্যাকরণ লিখেছেন কুইজাদা। বহু মানুষ ইতকুইল ভাষা শিখতেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে বিষয়টা যে একেবারেই সহজ নয়, সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কতটা কঠিন? সেটা জানতে গেলে এই ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো জানা প্রয়োজন।
মূলত দুটি উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে ইতকুইল ভাষা তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্যদুটি আপাত দৃষ্টিতে বেশ পরস্পরবিরোধী। প্রথমত, যত কম সম্ভব বর্ণের ব্যবহার করা হবে এই ভাষায়। দ্বিতীয়ত, একটি বাক্যে যথাসম্ভব কম শব্দ থাকবে। সর্বোচ্চ ১৫টি শব্দের বাক্য লেখা সম্ভব এই ভাষায়। তবে সাধারণত এক একটি বাক্য দুই-তিন শব্দেরই হয়ে থাকে। অন্যদিকে ২০০৪ সালে রাশিয়ার ‘কম্প্যুটেরা’ পত্রিকায় যখন প্রথম ইতকুইল ভাষার কথা প্রকাশিত হয়, তখন এতে ছিল ৬৫টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১৭টি স্বরবর্ণ। আর ছিল শ্বাসাঘাত সংক্রান্ত ৮টি চিহ্ন। প্রথম খবর প্রকাশের পর থেকেই অনেকে ইতকুইল শেখার বিষয়ে আগ্রহ জানাতে থাকেন। কিন্তু এই শেখানোর পর্বেই কুইজাদা বুঝতে পারেন, ভাষাটা আরেকটু সহজ করা প্রয়োজন। তাই ২০০৭ সালে নতুন একটি ব্যাকরণ লেখেন, সেখানে ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা কমিয়ে করা হয় ৩০ এবং স্বরবর্ণের সংখ্যা ১০। পরের বছরেই অবশ্য সংখ্যাটা আরেকটু বাড়ান তিনি। এখন ইতকুইল ভাষায় স্বরবর্ণ রয়েছে ১৩টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৪৩টি।
ইতকুইল ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল, এটি শব্দনির্ভর নয়। ধ্বনিনির্ভর। আর তাই আমাদের স্বাভাবিক ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলিকে সাংকেতিক চেহারা দেওয়াই এই ভাষার প্রথম কাজ। এই কাজটাও খুব সহজ নয়। কারণ আমরা স্বাভাবিক ভাষায় যে সমস্ত বক্তব্য উহ্য রাখি, ইতকুইল ভাষা তাকেও প্রকাশ করতে চায়। ধরা যাক, কেউ বললেন, আমার বাগানে প্রথম ফুল ফুটেছে। এই বাক্যটিতে তিনি উল্লেখ করলেন না, যে তাঁর একটি বাগান আছে। ইতকুইল ভাষায় একটিমাত্র বাক্যের মধ্যেই সেই কথাটিকেও উল্লেখ করতে হবে। এমনই প্রায় অসম্ভব সব উদ্দেশ্যকে একটিমাত্র ৩৭৫ পাতার ব্যাকরণ বইয়ের মধ্যে বেঁধেছেন কুইজাদা।
আরও পড়ুন
প্রাণীদের সঙ্গে কথপোকথন, পোষ্যের ভাষা শেখাচ্ছেন মার্কিন মহিলা
ইতকুইল এমন একটি ভাষা, যাতে প্রতিটা চিহ্নের নিজস্ব অর্থ রয়েছে। আবার সেই চিহ্নগুলিকেও ১৮টি স্টেমে ভাগ করা হয়েছে, যাদের আলাদা আলাদা চিহ্ন রয়েছে। প্রতিটা শব্দকেই তাই ১৮ রকমভাবে লেখা যায়, যাদের অর্থ আবার আলাদা আলাদা। ছোটো থেকেই বাবার ছাপাখানায় দিন কাটাতেন কুইজাদা। লস-অ্যাঞ্জেলসের সেই ছাপাখানায় নানা ভাষার বই ছাপা হত। আর সেইসব ভাষা শিখতে শিখতে কুইজাদা প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন, প্রতিটা ভাষার শব্দভাণ্ডারে বিপুল পার্থক্য থাকলেও তাদের ধ্বনিগঠনের সাদৃশ্য রয়েছে। সেই সাদৃশ্যকে হাতিয়ার করেই তৈরি করে ফেললেন আস্ত একটি ভাষা। কুইজাদা অবশ্য আশা করেন না এই ভাষা কখনও মানুষের কথোপকথনের ভাষা হয়ে উঠবে। তিনি চান বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজশাস্ত্রের মতো চিন্তাশীল বিষয়ে গবেষণার কাজে লাগুক এই ভাষা। তবে গবেষকরাও তো মানুষ। এই বাড়তি জটিলতার মধ্যে পড়তে তাঁরা কতটা আগ্রহ দেখাবেন, আপাতত সেটাই দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন
রুশ ভাষা আগ্রাসনেরও শিকার ইউক্রেন, ঘনাচ্ছে তর্ক
Powered by Froala Editor