অখণ্ড ভারতের মানচিত্র, সঙ্গে ভারতমাতার বন্দনা; ব্রিটিশদের কোপে হাতিবাগান সর্বজনীনের পুজো

সত্তরের দশক। বাংলায় তখন নতুন করে তৈরি হচ্ছে একধরনের বিপ্লবী প্রচেষ্টা। নকশাল আন্দোলন এই শহরে  অজানা কাহিনি ছড়িয়ে গিয়েছে। শুধুই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নয়, একসময় দুর্গাপুজো করা যাবে না বলেও ডাক দিয়েছিলেন নকশাল নেতৃবৃন্দ। বলা বাহুল্য, আম বাঙালি সেদিন সেই কথা মেনে নেননি। তবে সশস্ত্র বিল্পবীদের নিয়ে আতঙ্ক তো ছিলই। বড়ো বড়ো পুজো উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। কোনো অঘটন ঘটবে না তো? অবশ্য পুজোর আগেই তাঁদের সুর বদলে গেল। আর তার কারণ একটিমাত্র পুজো। “পুজোর আগে চারু মজুমদার এবং কানু সান্যাল সহ সমস্ত গোষ্ঠীর নকশাল নেতাদের রাজি করিয়ে শেষ পর্যন্ত নিষ্কণ্টক দুর্গাপুজোর ব্যবস্থা করেছিল হাতিবাগান সর্বজনীন।” বলছিলেন ক্লাবের বর্তমান সম্পাদক শ্যামল রায় গুপ্ত। আসলে এই পুজোর উদ্যোগও যে নিয়েছিলেন এক সময়ের বিপ্লবীরাই। তখন অবশ্য ভারত পরাধীন। আর দুর্গাপুজো ছিল সেই পরাধীন জাতির আত্মপরিচয়ের একটা প্রমাণ। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারেননি নকশাল নেতারাও।

“আমরা ১৯৩৫ সাল থেকে এই পুজোর বিষয়ে সঠিক তথ্য পাই। তাই সেটাকেই শুরু বলে ধরে নিই। কিন্তু আসলে কিন্তু তা নয়। এর আগেও এখানে পুজো হত। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত মানুষরাই পুজোর আয়োজন করতেন।” এমনটাই জানাচ্ছেন ক্লাবের সহকারী সম্পাদক শুভম রায় গুপ্ত। তাই খাতায় কলমে বয়স ৮৬ হয়, বাস্তবে তার বয়স ১০০ ছাড়ালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসের সারণি বেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলে সত্যিই সব কেমন অবাক করা লাগে। দুর্গাপ্রতিমার পিছনে চালচিত্রের জায়গায় রয়েছে একটা ভারতের ম্যাপ। অখণ্ড ভারতের মানচিত্র। আর প্রতিমার নিচে লেখা, ‘বন্দে মা তরম’। যেন ভারতমাতা আর দেবী দুর্গা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন। “বহুবার ব্রিটিশ পুলিশের কোপের মুখে পড়েছিল এই পুজো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একবারও পুজো বন্ধ হয়নি।” হাসতে হাসতে বলছিলেন পুজোর আহ্বায়ক তথা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শাশ্বত বোস, “এবারেই দেখুন না। বন্ধ হতে হতেও শেষ পর্যন্ত হল না। মা নিজের পুজোর ব্যবস্থা নিজেই করে নেন।”

 

প্রতিমার পিছনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র, আর নিচে ‘বন্দে মা তরম’; এই প্রথা চলেছে স্বাধীনতার পরেও। আসলে সংগ্রামীরাও তো মেনে নিতে পারেননি এই দেশভাগ। সেই অখণ্ড স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্নটুকুকেই যেন খুঁজতে চাইতেন এই পুজোর মধ্যে। কিন্তু ক্রমে সময় বদলেছে। বদলেছে মানুষের রুচিও। ১৯৮৫ সালে তাই পুজোর ৫০ বছরে শুরু হল প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেবছর মণীন্দ্র কলেজের এক ছাত্র গান গাইলেন সারা রাত ধরে। তাঁর নাম শানু ভট্টাচার্য। পরে কুমার শানু নামেই অবশ্য বিখ্যাত হয়ে উঠবেন তিনি। সেই বড়ো হওয়ার যাত্রাপথেও ওই একটা রাতের স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। ১৯৯৭ সালে হাতিবাগান এলাকার সুখেন্দু মুখার্জির হাত ধরেই শুরু হল ‘থিম পুজো’। আর সেবারেই এল ‘এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান’। তবে এবার তো ‘থিম পুজো’কে আরও খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বাজেটও বেশি নেই। তখন আর্ট কলেজের একজন ছাত্রকে সামান্য মজুরিতে দায়িত্ব দেওয়া হল। তাঁর নাম সনাতন দিন্দা। হাতিবাগান সর্বজনীনেই কাজ শুরু তাঁর।

১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত শিল্পী ছিলেন সনাতন দিন্দা। ২০০৩ সালে সুশান্ত পাল প্রথম পুজোর কাজে হাত দিলেন, সেও হাতিবাগান সর্বজনীনেই। পরিমল পাল, নব পালের মতো শিল্পীদের যাত্রা শুরুও এখানেই। “আসলে বাজেট অল্প হলেও শিল্পীকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিই বলেই হয়তো তাঁরা আরও এগিয়ে যেতে পারেন।” বলছিলেন ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক সুগত নায়েক। শিল্পীরা প্রত্যেকেই, তাঁর কথায়, হয়ে ওঠেন ‘পরিবারের একজন’।

সময়ের নিয়মে বয়স হল ৮৬ বছর। এখনও কিন্তু তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েনি। কাগজের টুকরো দিয়ে গোটা মণ্ডপ সেজে উঠছে। একমনে কাজ করে চলেছেন শিল্পী। হাতে সময় বেশি নেই। অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করতে হত। কিন্তু যেটুকু সময় আছে তাকেই ব্যবহার করতে হবে তো। যে পুজো ব্রিটিশ সরকার বন্ধ করতে পারেনি, সেই পুজোকে টিকিয়ে রাখার অর্থ তো একটা ইতিহাসকে টিকিয়ে রাখা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More