১৯২৯ সাল। কলকাতায় ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে স্বাধীনতার আন্দোলন। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে বিপ্লবীরা। দাবি একটাই, ইংরেজ ভারত ছাড়ো। এমন পরিস্থিতিতে শহরের বুকে পা রাখলেন টাউ মোয়ে। জন্ম হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে, পেশা এবং নেশা দুটোই সঙ্গীত। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জগতে পিয়ানো আর স্প্যানিশ গিটারের রমরমা। তারই মধ্যে টাউ মোয়ে হাতে তুলে নিয়েছেন স্টিল গিটার, আরও ভালো করে বললে হাওয়াইয়ান গিটার। ভাই-বোনদের নিয়ে তৈরি করা ব্যান্ডের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দিতে চান এই বাদ্যযন্ত্রকে। সেই সূত্রেই ভারত এবং কলকাতায় আসা তাঁর।
কথায় বলে, সঙ্গীতের কাছে এসে গোটা বিশ্বের পথ এক হয়ে যায়। শুধু সঙ্গীত নয়, সৃষ্টির মজাই এখানে। এক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম হল না। কলকাতায় এসে টাউ মোয়ে’র সঙ্গে পরিচয় হল গার্নে নিসের। কে এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষটি? সেই সময় কলকাতার ভেতরে একটু কান পাতলে এঁর নাম বেশ জোরের সঙ্গেই শুনতে পাবেন। বাংলার বুকেই বেড়ে ওঠা তাঁর; আদ্যোপান্ত খেলোয়াড় তিনি। একদিকে নয়, নানাদিকে তাঁর প্রতিভার রথ এগিয়ে আছে। কখনও বাংলার হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলছেন, কখনও সেই হাতই সঙ্গী হয়েছে হকি স্টিকের। বহু বছর বাংলার হয়ে খেলেছেন তিনি। পাশাপাশি ছিল ফটোগ্রাফির নেশা। পাখিদের নিয়ে এমনভাবে পড়াশোনা করেছিলেন যে, সেই জ্ঞান অবাক করে দিয়েছিল কিংবদন্তি পক্ষীবিদ সালিম আলিকে। চেয়েছিলেন, গার্নে নিসের সঙ্গে যৌথভাবে একটা বই যদি লেখা যায়। তাঁর গুণমুগ্ধদের তালিকাটা যে বেশ দীর্ঘ! খেলতে খেলতে একবার স্বয়ং ধ্যানচাঁদ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- তুমি কোথা থেকে এসেছ? কী রকমের খেলোয়াড় তুমি! যেন স্বর্গ থেকে খেলতে নেমেছ…
এহেন মানুষটি গিয়ে হাজির হলেন টাউ মোয়ে’র কাছে। হাওয়াইয়ান গিটার শুনে সেই সম্পর্কে উৎসাহ জাগল মনে। ব্যস, যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মোয়ে পরিবারের কাছে সঙ্গীত শিখতে শুরু করলেন গার্নে নিস। ধীরে ধীরে সরে গেল খেলা, ক্যামেরা। বরং সঙ্গীত ও সুরই হয়ে উঠল ধ্যানজ্ঞান। এমন এক ছাত্র পেয়ে টাউ মোয়েও দারুণ খুশি! তিনি হয়তো দেখতে পারছিলেন ভবিষ্যৎটা। দেখতে পাচ্ছিলেন, এই যুবকের হাত ধরেই বাংলা তথা ভারতের সঙ্গীত জগতে আসবে বদল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের দিকে পা বাড়াবে হাওয়াইয়ান গিটার। তৈরি হবে ইতিহাস…
বাস্তবিকই তাই হয়েছিল। গার্নে নিস নিজে না করলেও, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরেই সেই বদলের মুখোমুখি হয়েছিল দেশ। মোয়ে’র কাছে শেখা শেষ হলে তিনি নিজেই একটি ব্যান্ড শুরু করেন; নাম ‘দ্য আলোহা বয়েজ’। চারজন সদস্যের হাত ধরে কলকাতা তথা বাংলার বুকে শুরু হল ‘হাওয়াইয়ান ঝড়’। চল্লিশের দশক থেকে আলোহা বয়েজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে এইচএমভি থেকে ৬০টিরও বেশি মিউজিক রেকর্ড, প্রতিটা জায়গায় হাওয়াই দ্বীপের তাজা হাওয়া নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। সেইসঙ্গে শহরবাসী দেখল একটি নতুন যন্ত্র। গিটারের মতোই; কিন্তু বাজানোর রীতিটা একটু অন্য। এখানে একটি স্টিলের বার দিয়ে তারের ওপর স্লাইড করানো হয়, আর সেখান থেকেই বেরোয় সুর।
আরও পড়ুন
যেতে হয়নি সুইডেনে, রবীন্দ্রনাথের জন্য কলকাতাতেই হাজির হয়েছিল নোবেল পদক
পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় এসে সেই হাওয়াইয়ান গিটারের সুরই শুনেছিলেন যোধপুরের এক তরুণ। নাম, ব্রিজভূষণ কাবরা। এত পরিষ্কার, সুন্দর আর শুদ্ধ আওয়াজ যন্ত্রটির! যদি আমিও শিখতে পারতাম! এই ভাবনা থেকেই শুরু হল হাওয়াইয়ান গিটার শেখা। গার্নে নিসের কাছ থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। এরপরই ১৯৬৭ সালে বের করেন নিজের অ্যালবাম ‘কল অফ দ্য ভ্যালি’। বাঁশিতে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, সন্তুরে শিবকুমার শর্মা; আর হাওয়াইয়ান গিটার নিয়ে ব্রিজভূষণ কাবরা। প্রথমবার গিটারের বুকে বাজল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। যেন ম্যাজিক সৃষ্টি হল! তৈরি হল ইতিহাস। কেউ ভেবেছিল, গিটার এসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে এভাবে জায়গা খুঁজে পাবে! পণ্ডিত ব্রিজভূষণ কাবরা থেকে পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভাট— ট্র্যাডিশন এখনও চলছে…
তবে এইসবের পেছনে চালচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গার্নে নিস। কলকাতার বুকে যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন, আজ তা পূর্ণতা পেয়েছে নতুনভাবে। পাশ্চাত্য যন্ত্রকে আপন করে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। হাওয়াইয়ান স্লাইড গিটারের আওয়াজ পৌঁছে দিয়েছিলেন ঘরে ঘরে। ১৯৯৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সঙ্গীতই ছিল গার্নে নিসের প্রাণভোমরা। এভাবেই সঙ্গীতের কাছে এসে আমাদের রাস্তাগুলো মিলে যায়। আমরাও মিশে যাই, একাকার হয়ে যাই…
আরও পড়ুন
জেলের ভেতরেই বিশ্বাসঘাতককে হত্যা; কানাইলালের চিতাভস্ম সংগ্রহ করতে ভিড় কলকাতায়
তথ্যসূত্র ও ছবিঋণ - ‘Calcutta’s Hawaiian Summer’, Naresh Fernandes, Tajmahal Foxtrot
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কলকাতার রাস্তা পরিষ্কার করত ট্রাম, চলেছে স্টিম ইঞ্জিনেও