কথার জাদুতে মোড়া দৈববাণী, ভুল অর্থে ‘ফাঁদে’ পড়েছেন বহু সম্রাট

গ্রিক পুরাণে সূর্য ও আলোর দেবতা অ্যাপোলো (Apollo। জিউসের পুত্র তিনি, প্রবল তাঁর ক্ষমতা। যার মধ্যে একটি হল ভবিষ্যৎবাণী করার দক্ষতা। তবে এসব কাজ নিজে করতেন না। গ্রিসের ডেলফি-র মন্দিরে নিযুক্ত করেছিলেন নারী পুরোহিতদের। যাঁদের নাম ছিল পাইথিয়া (Pythia)। দেশের রাজারা তো বটেই, সাধারণ মানুষও মন্দিরে ছুটে আসত দৈববাণীর আশায়। তবে, ব্যাপারটা এতটাও সহজ নয়। বহু সাধনার পর পাওয়া যেত পাইথিয়ার দর্শন এবং তাঁর বাণীতে মিশে থাকত অদ্ভুত রহস্য। যার আলো-আঁধারি অর্থ না বুঝতে পেরে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকেই। আর সেসব নিয়েই তৈরি হয়েছে 'ডেলফির ওরাকল'-এর (Oracle of Delphi) রহস্য।

গ্রিসের পুরাণ ও ইতিহাসে ডেলফির মন্দিরের ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। অনুমানিক খ্রিস্ট-পূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে বানানো হয় এই স্থাপত্যকর্মটি। করিন্থ উপসাগরের উত্তরপ্রান্তে পারনাসাস পাহাড়ের গায়ে আজও রয়ে গেছে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। যুগ যুগ ধরে পূজিত হয়েছে পুণ্যভূমি রূপে। মূলত অ্যাপোলো-র মন্দির হলেও আসল খ্যাতি ছিল পাইথিয়া-র ভবিষ্যৎবাণীর জন্য। নিশীথ রাতে ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে জেগে ওঠেন তিনি। তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে উত্তর দিতে থাকেন আগন্তুকের প্রশ্নের। যেন স্বয়ং অ্যাপোলো ভর করেছে তাঁর উপর। তবে, পাইথিয়া বিশেষ কোনো নারী নয়। সময়ান্তরে গ্রিসের উচ্চবংশীয় সুন্দরী কিশোরী-যুবতীদের নির্বাচিত করা হত এই কাজের জন্য।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিষয় নয়, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাকৃতিক সংকটের কালেও মানুষ শরণাপন্ন হত ‘ডেলফির ওরাকল’-এর। তবে, খুব স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার ছিল রাজাদের। কথিত, দেশজয়ে বেরোনোর পূর্বে আলেকজান্ডারও (Alexander) এসেছিলেন ভবিষ্যৎবাণী শুনতে। তাঁর কামনা পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু বোকা বনে গেছিলেন অনেকেই। যেমন, লাইডিয়া সাম্রাজ্যের রাজা ক্রোয়েসাস (Croesus)। যেরকম তাঁর সম্পদ, তেমনই অহংকারী। হেরোডেটাসের লেখাতেও পাওয়া যায় তাঁর পরিচয়। প্রথম দুয়েকবার পাইথিয়ার দৈববাণী মিলে যাওয়ায় প্রায় সোনা দিয়ে মুড়ে দেন জায়গাটি। তারপর ঠিক করলেন পারস্যদেশ জয় করবেন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে ক্রোয়েসাস গেলেন মন্দিরে। ভবিষ্যৎবাণী হল, এই যুদ্ধে এক মহান সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে। আনন্দে মাতোয়াড়া হয়ে তিনি গেলেন যুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারস্যের রাজা ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’-এর হাতে হলেন বন্দি। ধ্বংস হয়ে গেল তাঁর স্বপ্নের ‘মহান সাম্রাজ্য’ লাইডিয়া।

আসলে ডেলফির বাণী বিচার করে নিত মানুষের ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতা। হঠকারী রাজার হাতে নিরাপদ নয় কোনো দেশই। বিশেষত খ্রিস্টপূর্ব ইউরোপের স্বশাসিত রাজাদের নিয়ম নীতিহীন আচরণে প্রায়ই বেঁধে যেত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। নেপথ্যের দৈবঘটনা যাই থাক না কেন, ডেলফি যেন সে-সবের মধ্যে সামঞ্জস্য নিয়ে আসার কাজ করত। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সম্রাট নিরোর (Nero) ঘটনা থেকে। হ্যাঁ সেই নিরো, যিনি নাকি রোম পুড়ে যাওয়ার সময় বেহালা বাজিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গেও জড়িয়ে ডেলফির বাণী ভুল বোঝার ব্যর্থতা। অন্তত প্রচলিত গল্প বলছে সেরকমই। ৬৭ সাল নাগাদ রোমসম্রাট নিরো এলেন ডেলফি দর্শনে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০ হলেও, তার মধ্যেই করে ফেলেছেন মাতৃহত্যার মতো অপরাধ। আর সেই কারণে তাঁকে বিদ্রূপ করেন পাইথিয়া। জানিয়ে দেন, দেবতার মন্দিরে খুনির কোনো স্থান নেই। ক্রোধে অন্ধ হয়ে নাকি পাইথিয়াকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন নিরো।

আরও পড়ুন
গ্রিসের ধ্বংসস্তূপ থেকে আবিষ্কৃত ২ হাজার বছরের পুরনো হারকিউলিস-মূর্তি

অবশ্য, মৃত্যুর আগেই পাইথিয়া সাবধান করেছিলেন যে, ৭৩ সংখ্যাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর পতন। নিরো ভাবলেন, হয় তিনি আরো ৪৩ বছর বাঁচবেন, নতুবা আর ছয় বছর পরে ৭৩ সালে ঘনিয়ে আসবে বিপদ। আপাতত চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু ঠিক পরের বছরই কর ব্যবস্থার প্রতিবাদে বিদ্রোহ শুরু হয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে। তাদের নেতার নাম গালবা। অবশেষে ৬৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন নিরো। তাহলে কি ডেলফির বাণী মিলল না? মিলেছিল, কারণ ওই সময়ে গালবার বয়স ছিল ৭৩!

আরও পড়ুন
মৃতদেহের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করত গ্রিকরা, দেবতাদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল এই রীতি

এরকম অসংখ্য গল্প ছড়িয়ে আছে ‘ডেলফির ওরাকল’ নিয়ে। হয়তো এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারত, যদি না ৩৯০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রোমান সম্রাট থিয়োডোসিয়াস ধ্বংস করে দিতেন মন্দিরটি। তিনি ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী এবং মূর্তিপূজার বিরোধী। অবশ্য কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই মৃত্যু ঘটে তাঁর। ডেলফির অভিশাপ? নাকি নেহাতই উদ্ধত মানুষের কৃতকর্মের অনিবার্য পরিণাম? আজও হয়তো তাঁরা রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ান ডেলফির চারপাশে আর শোনা যায় আক্ষেপের আর্তনাদ। এই নিয়েও কিন্তু রয়েছে অনেক গল্প। সে কথা পরে কখনও...

Powered by Froala Editor