সুতোয় গিঁট বেঁধেই লেখালিখি করত প্রাচীন ইনকারা!

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়। দক্ষিণ আমেরিকার বুকে গড়ে উঠেছিল প্রকাণ্ড এক প্রাচীন সভ্যতা। ইকুয়েডর থেকে শুরু করে চিলি পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা এই সভ্যতাই ছিল সে-যুগে দুই আমেরিকার মধ্যে বৃহত্তম সভ্যতা। কথা হচ্ছে ইনকাদের নিয়ে। যার কেন্দ্রস্থল ছিল পেরুর মাচুপিচু শহর। আজ থেকে সাড়ে পাঁচশো বছর আগে আন্দিজের মাথায়, প্রায় ৮ হাজার ফুট উচ্চতায় কীভাবে এই প্রাচীন শহর নির্মিত হয়েছিল— তা আজও বিস্মিত করে ইতিহাসবিদদের। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, অন্যান্য সভ্যতার মতো কোনো নিজস্ব লিখিত ভাষা কিংবা লিপি ছিল না ইনকাদের। তবে কীভাবে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করত তারা? কীভাবেই-বা সংরক্ষণ করত তথ্য? 

এক কথায় উত্তর, সুতো বুনে। শুনে খানিকটা ভুরু কুঁচকাতে হয় বৈকি। তবে তথ্য, হিসেব কিংবা সমীক্ষার ফলাফল নথিভুক্ত করে রাখতে এমনই এক আশ্চর্য পদ্ধতির ব্যবহার করত ইনকারা (Inca People)। কিন্তু কীভাবে? আর সুতোর মধ্যেই যে সংরক্ষিত রয়েছে ইনকাদের ইতিহাস— এমন দাবি করার কারণই-বা কী?

১৯১২ সাল। আমেরিকান অ্যানথ্রোপলজিস্ট লেসলি লিল্যান্ড লকি পেরুতে গবেষণা করার সময় উদ্ধার করেন উলের তৈরি বেশ কিছু প্রাচীন সুতোর একটি বিশেষ সজ্জা। আনুভূমিক একটি সুতোর সঙ্গে সেখানে লম্বভাবে বাঁধা হয়েছে আরও বেশ কিছু সুতো। সেগুলির প্রত্যেকটিতে রয়েছে এক বা একাধিক গিঁট। সেই গিঁট বাঁধার ধরন, সুতোর রঙের মধ্যেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। কিন্তু এই বিশেষ সুতোর সজ্জার অর্থ কী? 

প্রাথমিকভাবে লেসলি মনে করেছিলেন এই সুতোর সজ্জা ইনকাদের পোশাক বা সাজসজ্জার একটি অঙ্গবিশেষ। যদিও পেরু থেকে উদ্ধার হওয়া অন্যান্য পোশাক-আশাকের সঙ্গে এ-ধরনের সুতোর অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তিনি। আবার ইনকাদের ধর্মীয় স্থানেও খুঁজে পাওয়া যায়নি এইধরনের সুতোর বাঁধন। ফলে পরবর্তীতে নিজের মত পরিবর্তন করেন লেসলি। সন্দেহ করেন, এই সুতোর মাধ্যমে আসলে বিশেষ কোনো পরিসংখ্যান বা গাণিতিক হিসেব করত প্রাচীন ইনকারা। 

এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় আট দশক। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে পুনরায় বিশেষভাবে বাঁধা এই সুতো নিয়ে গবেষণায় নামেন ইতিহাসবিদরা। শেষ পর্যন্ত এই রহস্যের জট খুলেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যারি আর্ট্রন এবং তাঁর ছাত্র ক্যারি ব্রেজিন। দক্ষিণ আমেরিকা তো বটেই, তাছাড়াও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মিলিয়ে প্রায় ৭৫০ এ-ধরনের সুতো আবিষ্কার করেন তাঁরা। সর্বপ্রথম এই সুতোর বাঁধনে লুকিয়ে থাকা তথ্যদের পাঠোদ্ধারের নেপথ্যেও রয়েছে তাঁরাই। 

গ্যারির কথায়, কথ্য ভাষা হিসাবে ইনকারা কেচোয়া ব্যবহার করলেও, কোনো লিপি ছিল না তাদের। ফলে, এই সুতোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গিঁট বেঁধে গাণিতিক হিসেব কিংবা কথা লিপিবদ্ধ করত তারা। যা আজ পরিচিত খিপু বা খুইপু (Quipu) নামে। দুটি গিঁটের মধ্যে দূরত্ব, তাদের প্রকৃতি, ফাঁসের সংখ্যা, এমনকি সুতোর রঙের মধ্যে দিয়েও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে বোঝাত প্রাচীন ইনকারা। যেমন কোনো সুতোয় গিঁট না থাকার অর্থ শূন্য। আবার ইংরাজি আট বা বাংলার চার (৪)-এর মতো দেখতে গিঁটের মাধ্যমে বোঝানো হত দশমিকের পরবর্তী সংখ্যা। তাছাড়া সুতোয় গিঁটে ফাঁসের সংখ্যার মাধ্যমে নির্ণিত হত কোনো বৃহত্তর সংখ্যার একক, দশক কিংবা শতকের অঙ্ক। অবশ্য শুধু গাণিতিক হিসেব নয়, বিভিন্ন কথিত তথ্যও সংরক্ষিত হত এইধরনের সুতোর মাধ্যমে। যদিও তার ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ আরওই জটিল।

এবার আসা যাক প্রমাণের কথায়। এই আবিষ্কারের কয়েক বছর পর, হার্ভার্ডের গবেষক গ্যারি এবং তাঁর আরেক ছাত্র ম্যানি মিড্রানো পেরুর সান্টা নদীর নিকটে গবেষণা করতে গিয়ে খোঁজ পান কিছু প্রাচীন গ্রন্থের। সেগুলি ইনকাদের লেখা নয়। তবে সমকালীন অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতা এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের লেখা গ্রন্থ। সেই বই পড়তে গিয়েই গ্যারি ও ম্যানি আশ্চর্য মিল পান সুতোর সজ্জার পাঠোদ্ধারের সঙ্গে। জনসংখ্যা, চাষাবাদের ফলে উৎপাদিত শস্যের পরিমাণ এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ তথ্য প্রায় ৯৫ শতাংশই মিলে যায় খিপুর সঙ্গে। 

মজার বিষয় হল, ষোড়শ শতকেরও মাঝামাঝি সময়েই ধ্বংস হয়ে যায় মাচুপিচু শহর। গুটি বসন্তের মহামারী ইতি টেনেছিল এই সভ্যতায়। পাশাপাশি ইউরোপীয়দের আগমনও কাল হয়ে দাঁড়ায় প্রাচীন আমেরিকান সভ্যতাগুলির জন্য। ধীরে ধীরে মুছে যায় ইনকাদের ইতিহাস। তবে সে-সময় স্প্যানিশ ঔপনিবেশকরা অনেকেই খিপু সংগ্রহ করে এনেছিলেন পেরু থেকে। তবে তার অর্থ কী, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না তাদের। পরবর্তীতে যা নতুন করে আবিষ্কৃত হয় ইউরোপ থেকেও। 

বর্তমানে সবমিলিয়ে প্রায় ৭৫০ খিপু সংরক্ষিত রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন মিউজিয়ামে। তবে সন্দেহ করা হয়, ইনকা সভ্যতার সকলেই এই খিপু তৈরি করতে বা তার পাঠ করতে জানতেন না। মাত্র গুটিকয়েক পণ্ডিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল খিপু তৈরির কৌশল। আর সেই কারণেই গণহারে খিপু পাওয়া যায় না পেরু থেকে। ভাবলে অবাক হতে হয়, যে-সময়ে ইউরোপে শুরু হয়ে গেছে গুটেনবার্গের ছাপাখানা, জিওফ্রে চসার লিখে ফেলেছেন ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’, সে-যুগে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র সুতোর মাধ্যমেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার এক আশ্চর্য পথে হেঁটেছিল ইনকারা। যার পাঠোদ্ধার করতে আধুনিক মানুষের লেগে যায় প্রায় একশো বছর!

Powered by Froala Editor

Latest News See More