যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আর বালি। তার মধ্যেই জেগে রয়েছে ভাঙা-চোরা জীর্ণ এক শহর। সবমিলিয়ে শ-খানেক পরিবারের বাস সেখানে। ধ্বসে পড়েছে অধিকাংশ বাড়ি। যেগুলো এখনও টিকে আছে, তাদের অবস্থাও বেশ করুণ। চুন-বালির গাঁথুনি দেওয়া পাথরের দেওয়ালজুড়ে ক্ষত ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। অথচ, এই মৃতপ্রায় শহরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। না, সোনা-রুপো, রত্ন-মণিমাণিক্য নয়। সম্পদ বলতে প্রাচীন সব গ্রন্থ। যেগুলোর কোনোটার বয়স ৫০০, কোনোটার ১০০০ বছর। কিছু কিছু আবার তারও প্রাচীন।
মৌরিতানিয়া (Mauritania)। অনেকেই হয়তো মৌরিটাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন নামটা। তবে তেমনটা একেবারেই নয়। যে-দেশের কথা হচ্ছে, সেটি অবস্থিত আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে। আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর বা তারও আগের কথা। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দে এর্গ ওয়ারানে বালিয়ারির বুকে গড়ে উঠেছিল এই আশ্চর্য ‘পাথুরে’ শহর। আসলে পশ্চিম আফ্রিকার যে-কোনো দেশ থেকে মক্কা-যাত্রার সময় তীর্থযাত্রীদের সাহারার ধুধু প্রান্তরে আশ্রয় দিত এই মৌরিতানিয়ান শহর, চিনগুয়েত্তি (Chinguetti)। প্রতিদিনই লেগে থাকত ক্যারাভান, পর্যটকদের যাতায়াত।
অবশ্য শুধু তীব্র তাপদাহ থেকে সাময়িক রেহাই বা আশ্রয় পেতেই এই শহরে অস্থায়ী ছাউনি ফেলতেন তীর্থযাত্রীরা, তেমনটা নয়। আসলে, এই শহরের খ্যাতি ছিল সেখানে লুকিয়ে থাকা আশ্চর্য সব গ্রন্থাগারের জন্য। সে-সময় থেকেই গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির শহর নামেই পরিচিতি পায় চিনগুয়েত্তি। সবমিলিয়ে এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল প্রায় ৩০টিরও বেশি গ্রন্থাগার।
জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ, ইউনানি চিকিৎসা থেকে শুরু করে ইতিহাস, মানচিত্র, সাহিত্য, ধর্ম ও গণিত— হরেক কিসিমের বই-এর সন্ধান মিলত এ-সকল লাইব্রেরিতে। আজ আমরা যে ছাপা বই দেখে অভ্যস্ত, এসব বই অবশ্য তেমন নয়। সবটাই হাতে লেখা। চামড়া কিংবা কাপড়ে বাঁধাই করা। সে-যুগে যেসকল বাসিন্দাদের বাড়িতে নিজস্ব গ্রন্থাগার বা গ্রন্থের সংগ্রহ থাকত, তাঁদেরকে উঁচু নজরে দেখত সমাজ। পাশাপাশি এই লাইব্রেরিতে বসেই তরুণ প্রজন্মকে পাঠ দিতেন প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষিকারা। হ্যাঁ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারাও অধিকার পেতেন নিজস্ব লাইব্রেরি তৈরির। তবে বিবাহের পর, মহিলাদের সংগ্রহ করা সমস্ত গ্রন্থের স্বত্ব চলে যেত স্বামীর কাছে। তাঁর মৃত্যুর পর ফের সেইসব গ্রন্থের অধিকার ফিরে পেতেন মহিলারা। তাছাড়াও গ্রন্থাগারের মালিকানা হাতছাড়া না করার জন্য, অবিবাহিত থাকার প্রবণতাও দেখা যেত অনেকের মধ্যেই।
আঠেরো শতক থেকেই ধীরে ধীরে গোটা আফ্রিকার দখল নেয় ইউরোপীয়রা। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে আফ্রিকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রাধান্য হারাতে থাকে ক্যারাভান চলার পথগুলি। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, সেইসময় থেকে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা কমেছে চিনগুয়েত্তির। যাত্রীদের সংখ্যা কমতে কমতে, বিশ শতকের শেষের দিকে পাকাপাকিভাবেই পরিত্যক্ত হয় মক্কা যাওয়ার এই পথ। শুরু হয় ক্ষয়।
এইসব লাইব্রেরির অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেলেও, বর্তমানে টিমটিম করে টিকে রয়েছে খান দশেক লাইব্রেরি। মাত্র দুটি লাইব্রেরির কথা বাদ দিলে, সেগুলির অবস্থাও বেশ শোচনীয়। রক্ষণাবেক্ষণের লোক নেই কোনো। মালিকও দেশ ছেড়েছেন বহুকাল। কেউ পাড়ি দিয়েছেন সৌদি আরবে, কেউ আবার দুবাই-এ আস্তানা গেড়েছেন। আসলে, এইসব লাইব্রেরিই একসময় উপার্জন জোগাত স্থানীয় মানুষদের। লাইব্রেরির টানে হাজার হাজার পর্যটকদের আনাগোনার কারণে লাভবান হতেন অন্যরাও। তবে পর্যটকদের যাতায়াত উঠে যাওয়ায়, জীবিকার খোঁজেই অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছেন মালিকরা। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কমেছে গ্রন্থ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংগ্রহের আগ্রহও। অন্যদিকে সময়ের আবহে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাজার বছরেরও প্রাচীন ঐতিহ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হানা দিয়েছে বন্যা, বেড়েছে বৃষ্টিও। তাতেও বিস্তর ক্ষতি হয়েছে পরিত্যক্ত লাইব্রেরিগুলির।
প্রশ্ন থেকে যায়, কোনোভাবেই কি এসব লাইব্রেরির সংরক্ষণ সম্ভব নয়? কেনই বা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থারা? না, তেমনটা বললে ভুল হবে খানিক। আসলে ইউনেস্কো এবং মৌরিতানিয়ান সরকার একাধিকবার প্রচেষ্টা করেছেন এইসকল লাইব্রেরির গ্রন্থ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে। তবে তাতে বাধা দিয়েছেন লাইব্রেরির মালিকরাই। তাঁদের কথায়, এইসব লাইব্রেরি ও গ্রন্থ তাঁদের গ্রামের ঐতিহ্য, সম্বল। ফলে, কোনোভাবেই তা হাতছাড়া করতে রাজি নন তাঁরা। তবে আর্থিক সাহায্য দান বা স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করা হলে, তাতে আপত্তি নেই তাঁদের। যদিও এই শর্তে স্বাক্ষর করতে নারাজ প্রশাসন। এমনকি চিনগুয়েত্তির এই ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে আজও ‘হেরিটেজ’-এর স্বীকৃতি দেয়নি ইউনেস্কো। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? হয়তো আরও কয়েক দশক। তারপর কি পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণভাবেই মুছে যাবে ‘লাইব্রেরির শহর’-এর অস্তিত্ব? উত্তর নেই কারোর কাছেই…
Powered by Froala Editor