সিকিমের পাহাড়ের মাথায় এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পথ। সেই পথ ধরে এগোতে থাকলে ভারত-চিন সীমান্ত। আরও এগোলে তিব্বতের রাজধানী লাসা। সেখানে রয়েছে হেক্সি করিডোর বা ছ-মাথা রাস্তার মোড়। দুটি পথ চলে গেছে চিনের পূর্বপ্রান্তে। একটি পথ আফগানিস্তান হয়ে পাড়ি দিয়েছে পশ্চিমে, ইউরোপে। অন্যদুটির একটি সংযুক্ত করে ভারতকে, অন্যটি উত্তরের মঙ্গোলিয়া।
‘সিল্ক রোড’ (Silk Route)। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে এই পথেই বাণিজ্য চলত ভারত, চিন, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিতেন পর্যটক, ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষার্থীরা। তাঁদের কারোর গন্তব্য ছিল নালন্দা, কারোর আবার তক্ষশীলা। সবমিলিয়ে এই বাণিজ্যপথই হয়ে উঠেছিল এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের সংস্কৃতি আদানপ্রদানের অন্যতম মাধ্যম। ফলে, তক্ষশীলা বা নালন্দাকে বাদ দিয়েও এই বাণিজ্যপথের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল একাধিক সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রস্থল। যার মধ্যে অন্যতম পশ্চিমে চিনের গানশু প্রদেশে অবস্থিত ডুনহুয়াং (Dunhuang)। এত বিস্তারে ডুনহুয়াং-এর ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও অবস্থান বলার কারণ, তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পাঠাগার গড়ে উঠেছিল এখানেই। এই গল্প সেই ঐতিহাসিক পাঠাগার নিয়েই।
বিশের দশকের শুরুর দিকে, পার্বত্য শহর ডুনহুয়াং-এর দুর্গম এলাকায় ধ্যান করতে গিয়ে আশ্চর্য এক গুহা আবিষ্কার করেন তাওবাদী সন্ন্যাসী ওয়াং ইয়ানলু। গুহার পিছনের দেওয়াল দেখেই তাঁর মনে হয়, সেটি নির্মিত কৃত্রিমভাবে। তাতে কয়েকবার পাথরের টোকা দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন এই দেওয়াল আসলে ফাঁপা। তারপর সেই দেওয়াল ভাঙতেই বেরিয়ে আসে আশ্চর্য এক স্বপ্নপুরী, বিশালাকার গ্রন্থাগার। ব্যাপারটা রীতিমতো স্তম্ভিত করে দিয়েছিল খোদ ওয়াংকেও। কারণ গোটা গুহাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পাথরের তৈরি অজস্র ছোটো-বড়ো বুদ্ধমূর্তি। যার কোনোটির উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। তাছাড়াও গুহার দেওয়ালে খোদাই করে লেখা আছে বৌদ্ধধর্মের অজস্র মন্ত্র, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের ছবি এবং বুদ্ধের বাণী। এছাড়াও গুহার এককোণে সংরক্ষিত প্রায় ৫০ হাজার পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন শিলমোহর। ওয়াং নিজে বৌদ্ধভিক্ষু। অথচ, তা সত্ত্বেও চিনের ডুনহুয়াং প্রদেশে লুকিয়ে থাকা এই গুহার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তাঁর। গুহার সম্পর্কে ধারণা ছিল স্থানীয় প্রবীণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদেরও। কবে তৈরি হয়েছিল এই গুহা? কেনই-বা সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল এটি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও বেশ কয়েক বছর। ঐতিহাসিক এই প্রত্নক্ষেত্রের গন্ধ পেয়ে হাজির হয়েছিলেন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ঐতিহাসিক, অনুসন্ধানকারী এবং গবেষকরা। সেই তালিকার অন্যতম এক গবেষক ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত অভিযাত্রী ও ইন্ডোলজিস্ট অরেল স্টাইন। এই বিশালাকার পাঠাগার সংরক্ষণ ও তার ইতিহাস অনুসন্ধান শুরু করেন তিনি। তাঁর গবেষণাতেই উঠে আসে আনুমানিক পঞ্চম থেকে একাদশ শতকেরও মধ্যে তৈরি হয়েছিল এই গুহা এবং গুহায় সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপিগুলি। তারপর প্রায় ৯০০ বছর সেগুলি আর মানুষের স্পর্শ পায়নি। পরিত্যক্ত হয়েছিল ডুনহুয়াং-এর দুর্গম পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত বহু বৌদ্ধ মন্দিরও।
ধারণা করা হয়, এই গুহার প্রধান গ্রন্থাগরিক ছিলেন হংবিয়াং নামের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। যিনি ছিলেন স্থানীয় এক বৌদ্ধ মঠের অধিকর্তা। তাঁর হাত ধরেই প্রথম শুরু হয়েছিল এই গ্রন্থাগার নির্মাণের প্রক্রিয়া। পরবর্তীতে, সপ্তম শতকে ভারতীয় বৌদ্ধভিক্ষ জুয়ানজাং-ও জড়িয়ে পড়েন এই গ্রন্থাগারের সঙ্গে। দশম ও একাদশ শতকে হান এবং মঙ্গোল আক্রমণ এবং সং রাজবংশের অত্যচার বাড়তে শুরু করে এই অঞ্চলে। আর সেই অরাজকতা থেকে ঐতিহাসিক এই পাঠাগারকে রক্ষা করতেই লুকিয়ে ফেলা হয় সমস্ত পাণ্ডুলিপি। কৃত্রিম দেওয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয় পাঠাগারের মূল অংশ। তারপর কালের প্রবাহেই মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায় এই আশ্চর্য গ্রন্থাগারের ইতিহাস।
বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও গণিত, ইতিহাস, সাহিত্য, একাধিক শাখার এশীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন-সহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লিখিত পাণ্ডুলিপির অনুসন্ধান মিলেছিল এই গুহা থেকে। পাওয়া গিয়েছিল বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান শাখার রীতি-রেওয়াজ ও তন্ত্রের লিখিত বই, বিশ্বের প্রাচীনতম কালিতে ‘ছাপা’ গ্রন্থও। গুটেনবার্গের ছাপাখানা তৈরির কয়েকশো বছর আগেই তিব্বত ও মধ্যচিনে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে ছাপা হত বই। দুঃখের বিষয়, এই বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপির অধিকাংশই চলে যায় ইউরোপীয় গবেষকদের সংগ্রহে। অরেল স্টাইন নিজেই নিজে গিয়েছিলেন দশ হাজার পাণ্ডুলিপি, মাত্র ১৩০ পাউন্ডের বিনিময়ে। ১৯২০-এর দশকে যখন এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব তুলে নেয় চিন প্রশাসন, তখন অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২০ শতাংশ পাণ্ডুলিপি। সেগুলি স্থানান্তরিত করা হয় বেজিং শহরে।
বর্তমানে তুতানখামেনের সমাধি, ডেড সি স্ক্রোলের পাশাপাশি ডুনহুয়াং পাণ্ডুলিপিদের জায়গা দেওয়া হয়েছে বিশ শতকেরও সেরা তিনটি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের তালিকায়। বছর কয়েক আগে ঐতিহাসিক এই পাণ্ডুলিপিগুলির ডিজিটাল সংস্করণ তৈরির জন্য বিশেষ প্রকল্প শুরু করে চিন প্রশাসনও। চিনের বিভিন্ন জাদুঘরে গেলেই দেখা মিলবে সেই ডিজিটাল পাণ্ডুলিপির। আগামীদিনে এশিয়া এবং ইউরোপের সম্পর্ক এবং এশিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য সরবরাহ করতে পারে এই পাণ্ডুলিপিগুলি— এমনটাই ধারণা গবেষকদের…
Powered by Froala Editor