কে বন্ধু, কে বন্ধু নয়— জানতে মৃত্যুর অভিনয় করেছিলেন মার্কিন কোটিপতি!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউবারিপোর্টের ডেক্সটার ম্যানসন। প্রকাণ্ড সেই রাজপ্রাসাদ-সম বাড়ির সামনে ভিড় করেছেন প্রায় তিন সহস্রাধিক মানুষ। থমথমে শোকস্তব্ধ পরিবেশ। বাড়ির প্রাঙ্গণে রাখা সাজানো একটি কফিন। হ্যাঁ, প্রয়াত হয়েছেন বাড়ির খোদ কর্তা। আর তাঁর শেষকৃত্যেরই অনুষ্ঠান চলছে। হাতে গোনা কয়েকজন স্মৃতিচারণ করলেন প্রয়াত ব্যক্তির সম্পর্কে। এবার আহারাদির পালা। হঠাৎ, বাড়ির অন্দরমহল থেকে ছিটকে এল আর্তনাদ। তারস্বরে কাঁদছেন বাড়ির মালকিন। ব্যাপার কী? ছুটে গেলেন অনেকেই। তারপরই অবাক হওয়ার পালা! বাড়ির মালকিনকে বেত্রাঘাত করছেন প্রয়াত কর্তা! এ যেন ঠিক ভৌতিক সিনেমার দৃশ্য।

হ্যাঁ, উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে এমনই কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। যার কেন্দ্রে ছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন বাণিজ্যপতি লর্ড টিমোথি ডেক্সটার। একেবারে নাটকীয় ভঙ্গিতেই মঞ্চস্থ করেছিলেন নিজের ‘মৃত্যু’-র ঘটনা। তবে সমস্ত কিছু পরিকল্পনা মাফিক হলেও, সামান্য ভুল হয়ে যায় তাঁর স্ত্রীয়ের। শোকে যেখানে তাঁর কাঁদার কথা, সেখানে খানিক হেসে এক আমন্ত্রিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ফেলেছিলেন তিনি। আর তাই শাস্তিস্বরূপ বেত্রাঘাতের শিকার হতে হয় তাঁকে। কিন্তু হঠাৎ এহেন ভুয়ো মৃত্যু মঞ্চস্থ করার কারণ কী?

পিছিয়ে যাওয়া যাক আরও একটু সময়। ১৭৪৮ সালে আমেরিকার এক কৃষক পরিবারে জন্ম ডেক্সটারের। তখনও স্বাধীন হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ছোট থেকেই চরম দারিদ্রের মধ্যেই বড়ো হয়েছেন তিনি। পেরতে পারেননি স্কুলের গণ্ডিও। অন্যদিকে কৃষিকাজেও যে মন ছিল তাঁর, তেমনটা নয়। ফলত, পেট চালাতে তিনি কাজ নিয়েছিলেন বস্টনে একটি চামড়ার দোকানে। তারপরেই ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। বস্টনে এক চায়ের পার্টিতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিধবা রমণী এলিজাবেথ ফ্রোটিংহামের। কিছুদিনের মধ্যেই গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। তারপর বিবাহ। এলিজাবেথে মৃত স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি পেয়েই রীতিমতো প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন ডেক্সটার। খুলে ফেলেন নিজস্ব একটি লেদারের দোকান। নিঃস্ব থেকে মিলিয়নেয়ার হওয়ার যাত্রা সেই শুরু।

অবশ্য ডেক্সটারের হঠাৎ এই উত্থানকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি প্রতিবেশীরা। আসলে কোটিপতি হয়ে ডেক্সটার নিজেও হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত দাম্ভিক এক ব্যক্তি। আর তাঁর এই আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অনেকেই চেষ্টা চালাতেন, তাঁর এই ব্যবসার প্রসার কীভাবে থামিয়ে দেওয়া যায়। ক্ষতি হবে জেনেই, কেউ তাঁকে নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে বলতেন ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে। আর কোনো কিছু না ভেবেই সেই ‘উপদেশ’ মাথা পেতে নিতেন ডেক্সটার। তবে, তাঁদের সেই চেষ্টার ফলাফল হয়েছিল সম্পূর্ণ উল্টো। যে ব্যবসাতেই হাত ঠেকিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন ডেক্সটার। ঠিক কীরকম?

কয়লার ব্যবসার কথাই ধরা যাক। এক তাঁর বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন, ব্রিটেনের নিউক্যাসল শহরে কয়লার চাহিদা প্রবল, এতএব কয়লার ব্যবসা করলে বেশ ভালোরকম লাভবান হবেন তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, নিউক্যাসেলের পার্শ্ববর্তী শহর ম্যাঞ্চেস্টারেই ছিল আস্ত দুটি কয়লার খনি। সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ব্রিটেনের এই শহর কয়লা আমদানি করবে না, তা তো স্পষ্টই। তবে বন্ধু পরামর্শ শুনে নিজেই একটি কয়লার খনি খুলে ফেললেন ডেক্সটার। জাহাজ বোঝাই করে সেই কয়লাও পাঠালেন নিউক্যাসেলে। অদ্ভুত ঘটনা, যখন সেই জাহাজ গিয়ে পৌঁছাল নিউক্যাসেলে, তখন সেখানকার খনিতে চলছে ধর্মঘট। মাঝখান থেকে সত্যিই ব্যাপক লাভবান হলেন ডেক্সটার। 

তবে তাঁর সঙ্গে সবসময়ই যে লেগে আছে ষড়যন্ত্রের ছায়া, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি ডেক্সটার। শেষে স্ত্রীয়ের কথায় টনক নড়ে তাঁর। আর তারপরেই, আদতে কারা তাঁর প্রকৃত বন্ধু, তা পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেই মতোই সাজিয়ে ফেলেন নিজের মৃত্যুর নাটকীয় ঘটনা। যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সেই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই ঘনিয়ে আসে মৃত্যুর ছায়া। ১৮০৬ সালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সেই প্রয়াত হন ডেক্সটার। তবে দুশো বছর পেরিয়ে আসার পর, আজও জনপ্রিয় খ্যাপাটে ব্যবসায়ীর সেই কিংবদন্তি…

Powered by Froala Editor