সমাধির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি শ্বেতপাথরের স্মৃতিফলক। তার গায়ে ক্লিপ দিয়ে টান টান করে আটকানো এক টুকরো ক্যানভাস কাপড়। তার ওপরেই সযত্নে রং পেনসিল বুলিয়ে চলেছেন এক ব্যক্তি। আর ক্যানভাসের স্মৃতিফলকে খোদাই করা লেখা ফুটে উঠছে একটু একটু করে।
ব্যাপারটা শুনতে খুব অদ্ভুত লাগাই স্বাভাবিক। এ-ধরনের অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার কারণ কী? সে-ব্যাপারে নয় পরে আসা যাবে। আপাতত বলা যাক এই আশ্চর্য ব্যক্তিটির কথা। স্কট কভার্ট (Scott Covert)। বিগত কয়েক দশক ধরেই এমন আশ্চর্য এক শিল্পের চর্চা করে চলেছেন এই মার্কিন শিল্পী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব, তারকাদের সমাধিক্ষেত্রের স্মৃতিফলকের ছাপ সংগ্রহ করে চলেছেন কাগজ, কাপড় কিংবা ক্যানভাসে। সেই তালিকায় মেরিলিন মনরো, অ্যান্ড্রু কুনান, ভ্যালেরি সোলানেস, স্যামি ডেভিস, ক্যান্ডি ডার্লিং, ইরানের শাহ, এডিথ বুভিয়ার বিয়েল-সহ রয়েছেন একাধিক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। কেউ শিল্পী, কেউ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, কেউ আবার রাজনৈতিক নেতা কিংবা খুনি। কারোর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বড়ো কোনো ট্র্যাজেডি, আবার কারোর মৃত্যু অতি স্বাভাবিক।
কভার্টের ভাষায় এই বিশেষ শিল্পটির নাম ‘মনুমেন্টস পেইন্টিং’ (Monuments Painting)। আর এই ছবি তৈরির পদ্ধতিটির নাম ‘রাবিং’। প্রয়াত ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিফলকের ছাপ নিয়ে, সেই ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অবশ্য কভার্টের এই কার্যকলাপকে শিল্প বলা যায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। এমনকি এই আশ্চর্য শিল্প-সাধনা করতে গিয়ে কখনও কখনও বিপদের সম্মুখীনও হতে হয়েছে তাঁকে। ষাটোর্ধ্ব শিল্পীকে রীতিমতো তাড়া করেছেন সমাধিক্ষেত্রের নিরাপত্তারক্ষীরা, ঘটেছে এমন ঘটনা। কখনও আবার এই ছবি আঁকার জন্য রাতের অন্ধকারে টর্চ নিয়ে পাঁচিল টপকে তিনি হাজির হয়েছেন সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এমন আশ্চর্য উদ্যোগের কারণ কী? এহেন স্মৃতিফলকের প্রতিকৃতি ‘সংরক্ষণের’ কারণ কী?
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। ১৯৭৬ সালে এক প্রিয়জনকে হারিয়েছিলেন কভার্ট। তারপর থেকেই সমাধিক্ষেত্রে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় তাঁর। শুধু প্রিয়জনের কবরে ফুল রেখে আসতেই যে যেতেন এমনটা নয়। বরং, সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ অন্যান্য ব্যক্তিদের এপিটাফ সে-সময় বিশেষভাবে আকর্ষণ করত তাঁকে। কভার্ট বুঝতে পেরেছিলেন প্রতিটি এপিটাফের সঙ্গেই জুড়ে থাকা আশ্চর্য কিছু গল্প। প্রিয়জনদের বার্তা। সাধারণ মানুষের সমাধিফলকই যদি এত আকর্ষণীয় হয়, তবে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিফলকে কী লেখা থাকে? এই প্রশ্নই দানা বাঁধতে শুরু করে তাঁর চিন্তায়। সেইসব স্মৃতিফলকের প্রতিকৃতি কি সংরক্ষণ করা যায় না?
এই চিন্তাভাবনা থেকেই ১৯৮৫ সালে প্রথম ‘রাবিং’ শুরু করেন তিনি। ডেট্রয়েট মেমোরিয়াল পার্কে সর্বপ্রথম তিনি রাবিং করেছিলেন থিওডোর রিচার্ডসের সমাধিফলকে। তারপর ধীরে ধীরে ক্রমশ বাড়তে থাকে তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরিধি। দেশ ছেড়ে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে তাঁর কাজ। প্রথমে এক একটি কাপড় বা কাগজে এক একজন ব্যক্তিত্বের ফলকের ছাপ আঁকলেও, পরবর্তীতে বৃহদাকার ক্যানভাসে একাধিক ব্যক্তিত্বের সমাধিফলকের প্রতিকৃতির কোলাজ আঁকা শুরু করেন কভার্ট। অনেকটা জমির প্লটের মতোই।
কভার্টের এই ‘শিল্প’ শুরুতে সমাদৃত না হলেও, বর্তমানে তাঁর হাত ধরেই দেশ-বিদেশের নানা প্রদর্শনীতে খ্যাতনামা তারকা ও ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিফলকের ছবি একই ছাদের তলা দেখতে পান অনুরাগীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স-সহ একাধিক দেশেও হয়েছে তাঁর ‘মনুমেন্টস পেইন্টিং’-এর একক প্রদর্শনী। শিল্পজগৎ যে কত বিচিত্র— তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ স্কট কভার্ট…
Powered by Froala Editor