শীত এলেই বন্ধ হয়ে যায় রক্ত চলাচল, তবুও বেঁচে থাকে এই ব্যাঙেরা!

এক জায়গায় চুপটি করে বসে আছেন ‘তিনি’। যাকে বলে, নট নড়নচড়ন। একটুও উঠছেন না, সরছেন না; এমনকি খেতেও যাচ্ছেন না। তাহলে কি মরে গেছেন? একেবারেই না। অথচ দেখে তো তাইই মনে হচ্ছে। মনুষ্যপ্রজাতিকে এমনই দ্বিধায় রেখে ‘তিনি’ দিব্যি ধ্যানমগ্ন, সাধকের মতো। কথা হচ্ছে আলাস্কার বিখ্যাত উড ফ্রগদের নিয়ে…

খুব বেশি হলে আমাদের হাতের তালুর মধ্যেই চলে আসবে এরা। ছোট্ট, সুন্দর একটি প্রাণী; অথচ তার মধ্যেই কিনা লুকিয়ে আছে এমন অদ্ভুত ক্ষমতা! ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বলা যাক। বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে আলাস্কার এই উড ফ্রগ নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়েন বিজ্ঞানীরা। আলাস্কা মানেই প্রখর শীত। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচেও নেমে যায়। তার মধ্যে কী করে থাকে এই ব্যাঙ? 

এখানেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। একটু একটু করে তাপমাত্রা নামতে শুরু করলেই উড ফ্রগদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। কোনো জলাশয়ের ধারে, ঝোপঝাড় বা শুকনো পাতার ওপরে চুপচাপ বসে থাকে এরা। একটু একটু করে তাপমাত্রা শূন্যের ঘর ছোঁয়; এবং আরও নিচে নামতে থাকে। উড ফ্রগের দেহের ভেতরের জল একটু একটু করে জমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে শরীরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জল একেবারে জমে বরফ হয়ে যায়। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, হৃদপিণ্ডও আর কাজ করে না। আর গোটা শরীর একেবারে কঠিন পাথরের মতো হয়ে যায়। এমনই অবস্থা হয় যে, পা ধরে টান মারলে পা ভেঙে চলে আসবে! 

এ তো কার্যত আত্মহত্যা! এভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় এরা। আজ্ঞে না, এখানেই আসল রহস্য। এমন দুর্গম পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকে এই ব্যাঙের প্রজাতি। শীত একটু কমে গেলেই ভেতরে জমে থাকা বরফ গলে যায়। আবার যেন জীবন ফিরে পায় উড ফ্রগ। ব্যাঙের শীতঘুম তো শুনেছেনই। কিন্তু এমন চূড়ান্ত পর্যায়ের শীতঘুমের সঙ্গে কি পরিচয় ঘটেছে আপনাদের? 

এখান থেকেই আরও গভীরে গবেষণা করতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরাও অবাক হয়ে যান এটা জেনে যে, কয়েকদিন নয়; অন্তত সাত মাস এমন অবস্থায় থাকতে পারে উড ফ্রগরা। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের আরও নিচে নেমে গেলেও বেঁচে যায় তারা। এবং এই তথ্যের সঙ্গে খুঁজে পেয়েছেন এমন পরিস্থিতির কারণ। কী করে ব্যাঙরা আবার জীবিত হয়ে ফিরে আসে, সেই রহস্যও উন্মোচন করেছেন তাঁরা। 

রহস্যের চাবিকাঠি একটাই— গ্লুকোজ। শরীরের যাবতীয় গ্লাইকোজেনকে গ্লুকোজে পরিণত করে নেয় এই উড ফ্রগ। এমনকি শীতের সময়ও, যখন একটু বরফ গলে আসে, শরীর সচল হয়, তখন লাফাতে শুরু করে এরা। ফলে আরও বেশি গ্লুকোজ তৈরি হয়; এবং এর মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বহুগুণ বেড়ে যায়। এমনিতে এই জিনিসটি হওয়া খারাপ; কিন্তু এমনটাই উড ফ্রগদের শাপে বর নিয়ে আসে। শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও, আভ্যন্তরীণ কোষগুলি জীবিত থাকে। অক্ষুণ্ণ থাকে কোষের ভেতরের জলও। গ্লুকোজ ঢুকে সেই অবশিষ্ট জলকে আরও ঘন করে তোলে। ফলে চট করে জমাট বাঁধে না এটা, কোষগুলিও সতেজ আর জীবিত থাকে। আর ঠিক এই উপায়ই ব্যাঙটিও নিজের প্রাণটিকে ধরে রাখে… 

আরও পড়ুন
ড্রাগ মাফিয়ার দৌরাত্ম্যে ফুরোচ্ছে জঙ্গলের আয়ু, অস্তিত্বরক্ষার লড়াই কলম্বিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর

আবার যখন শীত পড়ে যায়, যাবতীয় গ্লুকোজ পরিণত হয় গ্লাইকোজেনে। অতিরিক্ত জল প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। আর উড ফ্রগও বহাল তবিয়তে এগোতে থাকে পুকুরের দিকে। অভিযোজনের কি অদ্ভুত লীলা, তাই না! 

Powered by Froala Editor