সালটা ১৮৮৫। কৃষ্ণাঙ্গ এক যুবকের প্রেমে পড়লেন ডেসডিমনা। না, যুবকের নাম ওথেলো নয়। নিতান্ত ছাপোষা এক বাঙালি নাম। সুরেশ বিশ্বাস। তবে এর পরে আর নতুন কোনো ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করে থাকেনি তাদের জন্য। জীবনে সবসময় নাটকের প্রতিফলন ঘটবে, এমন তো কোনো কথা নেই। দুজনে একটু একটু করে গুছিয়ে তুললেন সংসার। ডানপিটে বাঙালি যুবক থিতু হলেন সংসারে। যোগ দিলেন ব্রাজিলের সেনাবাহিনীতে।
১৮৮৭ সালে কর্পোরাল, এরপর পদাতিক বাহিনীতে যোগ দিলেন সুরেশ বিশ্বাস। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। তার প্রভাব এসে পড়ল ল্যাটিন আমেরিকাতেও। ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রাজিলের রাজধানী রিও-ডি-জেনেরিও শহর আক্রমণ করল একদল বিদ্রোহী। তবে রিও শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তাঁরা ক্রমশ পিছু হটলেন। তবে পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিলেন না। পরিকল্পনা পালটে এগোতে লাগলেন শহরতলি নাথেরয়ের দিকে। এদিকে নাথেরয় শহরের সেনাপতি চিন্তিত। তাঁর হাতে মাত্র ৫০ জন সৈন্য। এত কম সেনা নিয়ে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব।
তখনই ডাক পড়ল সুরেশ বিশ্বাসের। রাতারাতি লেফটেন্যান্ট পদে অভিষেক হল তাঁর। মাত্র ৫০ জন সৈন্য নিয়ে নাথেরয় পুনরুদ্ধার রীতিমতো এক রূপকথা। যদিও এরপর আর পদোন্নতি হয়নি সুরেশ বিশ্বাসের। কালো চামড়ার একজন মানুষের লেফটেন্যান্ট হয়ে ওঠাও মেনে নিতে পারেননি অনেকে। তবে অনেকেই তাঁকে উল্লেখ করেন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস নামে। এই উপাধি হয়তো খুব ভুল নয়। কারণ ব্রাজিলের সাধারণ মানুষও তাঁকে কর্নেল বলেই সম্বোধন করতেন। আর কেউ কেউ বলতেন, ‘ব্রাজিলের রক্ষাকর্তা’। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে এই খবর এসে পড়ল কলকাতাতেও। অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হল এই বাঙালি বীরের পরিচয়। তবে এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সুরেশ বিশ্বাসকে নিয়ে আলোচনা। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ উপন্যাসে ফেলুদাও তাঁর সম্পর্কে এটুকুই জানতেন। কিন্তু সুরেশ বিশ্বাসের বিচিত্র জীবনের এটা শেষ অধ্যায় মাত্র। জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে নানা কাহিনি, যার সঙ্গে ঠিক বাঙালির ঘরকুনো চরিত্রকে মেলানো যায় না।
নানা দেশ ভ্রমণের স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। নিরাপদ জীবন ত্যাগ করে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। চাকরি নেই, পেটে খাবার নেই। এই অবস্থায় অ্যাডভেঞ্চারর ইচ্ছা যেন বালখিল্য। আবার আত্মসম্মান হারিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। মাদ্রাজের সমুদ্র উপকূলে দাঁড়িয়ে একদিন আত্মহত্যার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। ঠিক তখনই এক ইংরেজ বৃদ্ধ এসে বাঁচালেন সুরেশকে। দুই নাতির দেখভালের দায়িত্ব দিলেন এই বাঙালি যুবকের হাতেই। আবারও কলকাতায় ফিরলেন সুরেশ। তবে বাড়িতে নয়। কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আটসন সাহেবের কাছে।
আরও পড়ুন
এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয়, গুগল শ্রদ্ধা জানাল বাঙালি সাঁতারুকে
১৮৬১ সালে নদীয়া জেলার নাথপুরে জন্ম সুরেশ বিশ্বাসের। পরে পরিবার উঠে আসে বালিগঞ্জ এলাকায়। ১৪ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে আটসন সাহেবের কাছেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সুরেশ। কলেজের হোস্টেলে বিনাপয়সায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন আটসন সাহেব। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসে না সুরেশের। ফলে কর্তৃপক্ষও তাঁর উপর সন্তুষ্ট নন। শেষে কলকাতা ছাড়তে হল সুরেশকে। কিছুদিন স্পেনসেস হোটেলের অতিথিদের কলকাতা শহর ঘুরে দেখানোর গাইডের কাজ করলেন। তারপর জাহাজের চাকরি নিয়ে চলে গেলেন রেঙ্গুন। সেখানে কিন্তু মন বসল না। ফিরে আসার কথাই ভাবছেন। এমন সময় ঘটে গেল একটি ঘটনা। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ শুনলেন এক আর্ত চিৎকার। তারপর তাকিয়ে দেখলেন একটি বাড়ি আগুনে পুড়ছে। জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন সুরেশ। বহু কষ্টে বের করে আনলেন এক মগ যুবতীকে। সুস্থ হয়ে যুবতী তাঁর উদ্ধারকারীর প্রেমে পড়লেন। সুরেশও আকর্ষণ অনুভব করল। কিছুদিন প্রেম হল। কিন্তু বাউণ্ডুলে সুরেশকে বেঁধে রাখতে পারল না সেই ক্ষণিকের ভালোলাগা।
রেঙ্গুন থেকে সুরেশ ফিরলেন মাদ্রাজ। সেখান থেকে কলকাতা। কিন্তু আবারও অস্থির হয়ে উঠল মন। ডকের জাহাজের কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে লাগলেন সুরেশ। ঠিক এমন সময়ে একজন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের সহযোগিতায় সরকারি স্টুয়ার্টের চাকরি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লণ্ডনের ইস্ট অ্যান্ড পল্লীতে সস্তায় একটি ঘর ভাড়া নিলেন। কিছুদিন মুটের কাজ করলেন। কখনো সস্তায় হরেক জিনিস কিনে ফেরি করতে লাগলেন। আর তার ফাঁকে ফাঁকে চলল পড়াশোনা। গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন… নানাকিছু। ঘুরতে ঘুরতে কেন্ট প্রদেশে সার্কাসের খেলা দেখলেন সুরেশ। আর তারপর জুড়ে গেলেন দলের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
ওআরএস-কে এনে দিয়েছিলেন স্বীকৃতি, প্রয়াত কিংবদন্তি বাঙালি চিকিৎসক ডা. ধীমান বড়ুয়া
কিছুদিনের মধ্যেই নানা জীবজন্তুর খেলা শিখে নিলেন সুরেশ বিশ্বাস। বিশেষ করে তাঁর সিংহের খেলা তো রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। সার্কাস দলের বিজ্ঞাপনেও লেখা আঁকা হল সুরেশের মুখ। খাঁচার ভিতরে বন্দি সিংহের দল যেন বাধ্য শিশুর মতো তাঁর কথা শুনত, এমনটাই লিখেছিল ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র। এই সার্কাসের দলেই আবারও প্রেম এল সুরেশের জীবনে। সার্কাস দলেরই এক জার্মান যুবতী তাঁর প্রেমে পড়লেন। কিন্তু হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার খবরে জার্মানি ফিরে গেল সেই যুবতী। সুরেশও জার্মানি গেলেন, তবে প্রেমের জন্য নয়। ভাগ্যান্বেষনের উদ্দেশ্যে। হামবুর্গ শহরে একটি পশুশালায় পর্যবেক্ষকের কাজ নিলেন সুরেশ। এদিকে সেই জার্মান যুবতীর অন্যান্য প্রেমিকরা তখন সুরেশকে হত্যার জন্য গুণ্ডা লাগিয়েছেন। দুবার প্রাণে বেঁচে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন পালাতে হবে। আবারও এক সার্কাস দলের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে পাড়ি দিলেন আমেরিকা। তারপর সেখান থেকে ব্রাজিল। ব্রাজিলের বুকে সেই প্রথম কোনো ভারতীয়ের পা পড়ল।
নন-অ্যাকাডেমিক সুরেশ বিশ্বাস ততদিনে ইংরেজি, পর্তুগিজ সহ ৭টি ভাষায় পারদর্শী। বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি, সমাজনীতি – সবেতেই অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁর। ব্রাজিলের শহরে শহরে ঘুরে এইসব বিষয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন সুরেশ। আর তখনই আলাপ হল স্থানীয় এক চিকিৎসকের মেয়ে ডেসডিমনার সঙ্গে। এবার কিন্তু বাউণ্ডুলে জীবনের ইতি ঘটল। বয়সও হয়েছে অনেকটাই। সদ্য কৈশোর পেরনো সেই চাঞ্চল্য আর নেই। শেষ জীবন পর্যন্ত ব্রাজিলেই থেকে গিয়েছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। ১৯০৫ সালে রিও-ডি-জেনেরিও শহরেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। সেই সমাধি অবশ্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। শোনা যায়, শ্বেতাঙ্গরা বিদ্বেষের বশে ১৯১১ সালে তাঁর সমাধি ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের বিচিত্র জীবনকাহিনি মুছে ফেলতে পারেননি।
আরও পড়ুন
ডাক পেয়েছেন রানি এলিজাবেথের থেকেও, বাঙালিই মনে রাখেনি বিজ্ঞানী মাধবচন্দ্র নাথ-কে
তথ্যসূত্রঃ ১৫০ বছর আগে এক ঘরপালানো বাউণ্ডুলে সুরেশ বিশ্বাসের গল্প, অনিরুদ্ধ সরকার, এইসময়
ব্রাজিলে সেই ডানপিটে বাঙালি, অমিতাভ কারকুন, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
৫৮ বছর আগেও চিন-ভারত যুদ্ধে ভারতের ট্রাম্প কার্ড তিব্বতী সেনারা, পরিকল্পনায় এক বাঙালি