১৯৩৭ সাল। প্যারিসের গ্যাস বোর্ড ল্যাবরেটরি। সেখানে গবেষণারত দুই বিজ্ঞানী— জ্যাক বার্জিয়ার এবং আন্দ্রে হেলব্রোনার। দুই গবেষকই তখন যান লড়িয়ে দিচ্ছেন পদার্থের অণু থেকে আণবিক শক্তি নিষ্কাশনের জন্য। নানাভাবে চলছে পরীক্ষানিরীক্ষা। পদার্থের কতটা ভরকে শক্তিতে পরিণত করা সম্ভব— তা নিয়ে রীতিমতো হিসেবনিকেশও করছেন তাঁরা। এমন সময়ই ল্যাবরেটরিতে হাজির এক আধপাগলা বুড়ো। সারা গায়ে দারিদ্রের ছাপ। ছেঁড়া কম্বল জড়ানো গায়ে। বার্জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। তারপর বার্জিয়াকে আশ্চর্য সব কাহিনি শোনান তিনি। কাহিনি না বলে তাকে সতর্কবার্তা বলাই ভালো। কী সেই কাহিনি?
ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন অ্যালকেমিস্ট (Alchemist) হিসাবে। বলেছিলেন, অণু বা পরমাণু থেকে যে শক্তি নিষ্কাসনের চেষ্টা করছেন তাঁরা, সে-পরীক্ষায় বহু আগেই সফল হয়েছেন অ্যালকেমিস্টরা। তবে এই শক্তি মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে দিতে পারে আস্ত শহর। এমনকি তার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কয়েক যুগ ধরে দগদগে ক্ষতের মতো জেগে থাকতে পারে কোনো শহরের গায়ে। ফলে, এই পরীক্ষা যেনতেন-প্রকারেণ বন্ধ করতে হবে তাঁদের।
না, তাঁর কথাকে সে-সময় ততটাও গুরুত্ব দেননি বার্জিয়া। তবে তিনি যে হুবহু ঠিক ছিলেন, তা নিয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই কোনো। এই ঘটনার ঠিক আট বছর পরই জাপানের দু-দুটি শহর মুছে যায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে। তেজস্ক্রিয়তা প্রায় পঙ্গু করে দেয় কয়েকটি প্রজন্মকে। পারমাণবিক অস্ত্রের এই বীভৎসতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা ছিল না ম্যানহাটন প্রোজেক্টে যুক্ত থাকা গবেষকদেরও। অথচ এই ঘটনার ৮ বছর আগেই কীভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে দিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি? তাঁর পরিচয়ই বা কী?
ফুলকানেল্লি (Fulcanelli)। হ্যাঁ, এই নামেই বার বার ফিরে ফিরে এসেছেন তিনি। তবে তাঁর বাসস্থান কোথায়, তাঁর আসল নামই বা কী— সে-ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না কোথাও-ই। যদিও অনেকে দাবি করেন ফরাসি পদার্থবিদ জুলস ভায়োলাই আদতে ফুলকানেল্লি। সে যাই হোক না কেন, ঊনবিংশ বা বিংশ শতকেও যে অ্যালকেমির চর্চা হত গোটা ইউরোপজুড়ে তাঁর অন্যতম প্রমাণ তিনি।
আমাদের চিরাচরিত বিজ্ঞান বা রসায়ন যেমন একাধিক মৌল বা যৌগের বিক্রিয়ায় নতুন যৌগ তৈরির পথ দেখায়, ঠিক তেমনই অপরসায়ন বা অ্যালকেমি কোনো পদার্থকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে ভিন্ন একটি পদার্থে। সেখানে যেমন রাসায়নিক বিক্রিয়ার অবদান রয়েছে, তেমনই রয়েছে আশ্চর্য সব কলাকৌশল এবং ক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চোখের সামনেই পাথরখণ্ড বদলে যেতে পারে সোনায়। তবে এসবের সীমানা ছাড়িয়ে ফুলকানেল্লি পৌঁছে গিয়েছিলেন আরও উচ্চস্তরে। বা তাঁর কথায় বলতে গেলে ‘দ্য গ্রেট ওয়ার্ক’-এর সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। কী এই গ্রেট ওয়ার্ক?
এই গ্রেট ওয়ার্ক-ই আদতে অপরিসীম শক্তির সন্ধান। যা অপরিমেয় ধ্বংসযজ্ঞ করতে সক্ষম। পাশাপাশি সময় নিয়ন্ত্রণ করার গুপ্তকৌশলও নাকি লুকিয়ে রয়েছে এই ‘ক্রিয়া’-র মধ্যে। রয়েছে অলৌকিক কর্মকাণ্ডের ঘটানোর ক্ষমতাও। যেমন, মানুষের চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
হ্যাঁ, এমনটাই নাকি করে দেখিয়েছিলেন তিনি। ১৯২৬ সালেই শিষ্যদের চোখের সামনেই হাওয়ায় মিলিয়ে যান ফুলকানেল্লি। তবে চলে যাওয়ার আগে নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ড ও গুপ্তবিদ্যা লিপিবদ্ধ করে তা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর শিষ্যদের হাতে। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে যথাক্রমে বই আকারে প্রকাশ পায় তাঁর এই গ্রন্থগুলি। ‘দ্য মিস্ট্রিস অফ দ্য ক্যাথিড্রাল’ এবং ‘দ্য ডুয়েলিং অফ দ্য ফিলোসফার’-খ্যাত এই গ্রন্থ দুটিকে আজও প্রামাণ্য বলে মনে করেন অ্যালকেমিতে বিশ্বাসী বহু মানুষ।
সে যাই হোক না কেন, সে-সময় তাঁর এই রহস্যময় অন্তর্ধান বইয়ে উল্লেখিত থাকলেও, তা খুব একটা সাড়া ফেলেনি সাধারণ মানুষের মধ্যে। এমনকি পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বার্জিয়া নিজের লেখায় উল্লেখ করতেও ফুলকানেল্লিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি কেউ-ই। তবে ১৯৪৫-এ পারমাণবিক বোমার সফল প্রয়োগের পরই রীতিমতো চর্চায় চলে আসেন ফুলকানেল্লি। এমনকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-ও বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল তাঁকে খুঁজে বার করার জন্য। তা না-হলে যে শত্রুপক্ষের হাতেও পৌঁছে যেতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের রহস্য। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল সিআইএ-র সকল প্রচেষ্টাই। আর ফুলকানেল্লি?
হ্যাঁ, এর পরেও অন্তর্ধানের পর্দা সরিয়ে আবার দেখা দিয়েছিলেন তিনি। ষাটের দশকে, সেবার দর্শন পেয়েছিলেন তাঁর শিষ্য ইউজিন ক্যানসেলিয়েট। ফুলকানেল্লির দুটি গ্রন্থ প্রকাশের নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই। বেনামী চিঠি পেয়ে ফ্রান্স থেকে ইউজিন পাড়ি দিয়েছিলেন স্পেনের সেভিয়া শহরে। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতেই কিছু মানুষ এক গোপন ডেরায় নিয়ে যায় তাঁকে। না, সেই রাস্তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি ইউজিনের। চৈতন্য ফিরেছিল প্রকাণ্ড এক রাজপ্রাসাদে। সেখানেই তিনি দেখা পান তাঁর গুরুর। সে-এক অদ্ভুত রূপ। বয়স যেন উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করেছে তাঁর। সারা মুখে তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্য। বদলে গেছে শারীরিক গঠনও। সেখানে পুরুষ এবং মহিলা— উভয় যৌনতার মানুষের বৈশিষ্ট্যই সুস্পষ্ট। চুল, নখ ঝরে গিয়ে নতুন করে গজিয়েছে নখ, কালো চুল।
ইউজিনের কথায় এই প্রাসাদে বসবাসকারী সমস্ত মানুষই নাকি অ্যালকেমিস্ট। না, এই প্রাসাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। এমনকি প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ স্মৃতি ছাড়া আরও কিছুই মনে ছিল না স্বয়ং ইউজিনেরও। প্রাথমিকভাবে তাঁর কথা অবিশ্বাস করা হলেও, পরবর্তীতে তাঁর পাসপোর্ট তদন্ত করে দেখা যায়, সত্যিই স্পেনে গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি স্পেনের রেজিস্টারেও খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর নাম। কিন্তু কোথায় কোথায় সময় কাটিয়েছেন তিনি স্পেনে— সে-সম্পর্কে কোনো তথ্যই খুঁজে বার করতে পারেননি গোয়েন্দারা। ফুলকানেল্লির এই গল্প আদৌ সত্যি নাকি পুরোটাই কাল্পনিক— তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে আজও। রয়েছে ধোঁয়াশা। কিন্তু স্পেনের বুকেই এক গোপন ডেরা রয়েছে অ্যালকেমিস্টদের— এমনটা ভাবতে মন্দ লাগে না বইকি। আর তা যদি থেকেই থাকে, তা-হলে তাঁরা নিশ্চয়ই সকলের অজান্তে খবর নিয়ে চলেছেন এই চলমান দুনিয়ার…
তথ্যসূত্রঃ
১. The enigma of Fulcanelli: The alchemist who vanished into thin air, Leo De, mysteriesrunsolved.com
২. Fulcanelli, A 20th-Century Missing Alchemist Who Accomplished Great Work, Irena Curik, History of Yesterday
Powered by Froala Editor