‘এখন বলো কে জোগাবে, স্বল্পতম দুগ্ধ/ এই সন্দেশ হে সন্দেশমুগ্ধ।’ মিষ্টিমেয় বাঙালির মায়ার মাতা কলকাতার একটি মিষ্টির দোকানের কথা আজ এই আলোচনায়। ৫৬ রামদুলাল স্ট্রিট। দোকানের পুরো নাম ‘গিরীশচন্দ্র দে ও নকুড়চন্দ্র নন্দী’।
উনিশ শতকের চতুর্থ দশক। ভারতবর্ষের গভর্নর স্যার হেনরি হার্ডিঞ্জ। ওরফে হাতকাটা হার্ডিঞ্জ। নেপোলিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধে হার্ডিঞ্জের একটা হাত যায় কাটা। হার্ডিঞ্জ তখন তালি কুড়চ্ছেন। তিনি নাকি ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিকে সরকারি চাকরি দেবেন। যদিও খাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ৮২৫ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র একজন ভারতীয়। এতে সরকারি চাকরির হকিকত সহজেই অনুমেয়। চাকরি হবে না বুঝেই মহেশচন্দ্র দে নেমে পড়লেন ব্যবসায়। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। মানিকতলা স্ট্রিটে ছোট একটি খোড়ো বাড়ির এক কোণে শুরু মহেশবাবুর মিষ্টি বিপণন।
মহেশবাবুর ছেলে গিরীশচন্দ্র দে। ছানা কাটায় সেই গিরীশ এক্কেরে শিল্পী। সন্দেশের দেশ বাংলাদেশে বাড়ে গিরীশের প্রসিদ্ধি। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘সন্দেশ বাংলাদেশে বাজিমাত করিয়াছে, যা ছিল খবর, বাংলাদেশ তাকেই সাকার বানিয়ে করে দিল খাবার। সেখানকার সন্দেশেও খবর-খাবারে অর্থাৎ সাকার-নিরাকারের শিবশক্তির মিলন।’ মিলনবাশি বাজল। গিরীশচন্দ্র তাঁর কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিলেন নকুড়চন্দ্র নন্দীর। নকুড় পেলেন অর্ধেক রাজত্ব, সঙ্গে রাজকন্যাও।
অতঃপর মেজাজি গিরীশের একটি কাহিনি শুনুন। প্রবল গরমে মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য তিনি একটা চৌবাচ্চায় শুয়ে থাকতেন। রাজা মানুষের চলন রাজার মতোই। চৌবাচ্চা, জলকেলি আর মাথার খেলায় তৈরি হয়েছিল অনেক সন্দেশই। গিরীশের অন্তিমকালে মৃত্যু পথযাত্রীর পা ছুঁয়ে নকুড়চন্দ্র নন্দী অঙ্গীকার করলেন, মিষ্টির ব্যবসা করবেন। ১৮৪৪ সালে (১২৫১ বঙ্গাব্দ) দোকানটির প্রতিষ্ঠা। এরপর বদলে গেল সন্দেশের চরিত্র।
আরও পড়ুন
নতুন চেহারায় ফিরছে মাখনলাল, ঐতিহ্যবাহী সন্দেশের পাশে এবার ফিউশন মিষ্টিও
নাটোরে তখন সাড়া ফেলেছে কাঁচাগোল্লা। শোনা যায়, বিদ্যাসাগর মহাশয়েরও নাকি জিভসেবা হয়েছিল কাঁচাগোল্লার স্বাদে। আর নকুড়বাবু, সন্দেশকে চিনির খপ্পর থেকে রেহাই দিলেন। শেষপাতে মিষ্টিসুখে মুখশুদ্ধি না হলে তাই পূর্ণতা নেই। এরপর প্রেরণার কথা বলতেই হয়। উনিশ শতকের এক বিবাহসভার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ‘কোন্নগরে বিবাহকালে ব্রাহ্মণেরা চণ্ডীমণ্ডপে বসে চিনির ডেলার সন্দেশ খেয়েছিলেন আর কলকাতার বাবুরা হালফ্যাশনের মিষ্টান্ন খেয়েছিলেন। ছানা অখাদ্য ছিল কারণ মনুর বিধান অনুযায়ী ফাটা দুধের সামগ্রী গ্রহণীয় নয়। এখনকার ছানা আর আম পট-চীজ একই জিনিস। ব্যান্ডেলের ডাচ কারিগরেরা বাঙালি কারিগরদের জার্মান ছানা এবং পনীর প্রস্তুত করতে শিখিয়েছিলেন।’
আরও পড়ুন
১৭৫ বছরের পুরনো মিষ্টির দোকান, সেখানেই তৈরি বিশ্বের প্রথম রসগোল্লা তৈরির যন্ত্র
কাঁচাগোল্লার মতো ফিকে সন্দেশ যখন ছানা কাটিয়ে জনপ্রিয় হতে পারে, তখন নকুড়ের সন্দেশ কেন নয়! ফিকে সন্দেশে হইহই করে গুড় মাখালেন নকুড়চন্দ্র। ব্যস, নতুন ব্যাকরণে বাংলার সন্দেশের ভূগোল বদল। আনুমানিক ১৯২৪ সালে নকুড়চন্দ্রের দেহাবসান হলেও উত্তরাধিকারে নকুড়ের সন্দেশ স্বমহিমাতেই।
কথোপকথনে উঠে আসে অনেক কথাই। নন্দী পরিবারের চতুর্থ পুরুষ প্রতীপ নন্দী বললেন, ‘আমাদের এলাকায় স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি। দাদু অনুকূলচন্দ্র নন্দীর কাছ থেকে শুনেছি তাঁর বাড়িতে আমাদের সন্দেশ যেত। আমাদের দোকানঘরের পিছনে মদন ঘোষ লেনে মান্না দে-র বাড়ি। মান্নাবাবুর আত্মীয়স্বজনেরা ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যান আমাদের সন্দেশ। সত্যজিৎ রায়ও আসতেন এখানে। বাগবাজারের বোস বাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ি, রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ি, পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়িতেও আমাদের সন্দেশ ফরমাশ পায়। কেকেআর-এর সংবর্ধনা সভায় আমাদের তৈরি ছানার কেক কেটেছিলেন শাহরুখ খান। অভিষেক বাচ্চনের বিয়েতে ঋতুপর্ণ ঘোষের সুপারিশে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিল আমাদের পারিজাত সন্দেশ।’
তাছাড়াও এখন ছানা আর গোলাপজল দিয়ে তৈরি হয় গোলাপ সন্দেশ। নরমপাকের জলভরা সন্দেশের কদর তো রয়েইছে। ছানার কেকে কামড় দিলে ‘ওয়াহ ওস্তাদ’ বলতেই হয়। এখানেই শেষ নয়। চকোলেট সিঙারা প্রস্তুত হয় কাজু, কাঠবাদাম, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি দিয়ে। ম্যাঙ্গো মৌসুমিরও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। উপর নিচে ছানার মাঝখানে পিঠেপুলির পুর দিয়ে বানানো এই মিষ্টির সে এক অনবদ্য স্বাদ! সরের মালাই, সরপুরিয়া, শীতকালে তৈরি হয় পাটালি গুড়ের সর মোহিনী। সন্দেশ, ক্ষীর আর পেস্তা মিশিয়ে রূপ পায় পারিজাত সন্দেশ। দিলখুশ সন্দেশ গড়ে ওঠে কেশর, ক্ষীর আর ছানা দিয়ে। নারকেল মেশানো চন্দ্রপুলির স্বাদও জিভে জল আনে আর আম্রপালির মাঝখানে আমসত্ত্ব, কাঠবাদামের মিশ্রণ যেন মিষ্টান্ন মিতরে জনাঃ।
মিষ্টিপ্রেমী বাঙালিকে 'গিরিশ আর নকুড়' ছাড়া আর কেই বা এরকম রসে-বশে রাখবে?
Powered by Froala Editor