১৪০ ছুঁইছুঁই ‘ফোক-টেলস অব বেঙ্গল’: কিছু অনন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি

গ্রামের সেরা গল্পকার শম্ভুর মাকে চিনিয়েছিলেন রেভারেন্ড লালবিহারী দে। শম্ভুর মায়ের কাছে গল্প শোনার জন্য নিয়ম করে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাতেন লেখক লালবিহারী (Lal Behari Day)। কথা হচ্ছে ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁরই লেখা ‘ফোক-টেলস অব বেঙ্গল’ (Folk Tales of Bengal) নিয়ে। অসাধারণ ব্যাপার হল, বিশিষ্ট ভারতীয় প্রশাসক স্যার রিচার্ড টেম্পলের পুত্র বেঙ্গল স্টাফ কর্পসের ক্যাপ্টেন আর. সি. টেম্পল তাঁকে লিখেছিলেন, ভারতের বয়স্ক মহিলারা যে অলিখিত গল্পগুলো বলেন, তার একটি সংগ্রহ পাওয়া গেলে খুব আকর্ষণীয় হবে। সন্ধ্যায় শিশুদের গল্প সুর করে শোনাতেন মা-ঠাকুমারা। সেসব নিয়ে লালবিহারী এই ধরনের একটি সংগ্রহ করতে পারবেন কি না, জানতে চেয়েছিলেন টেম্পল। লেখক লালবিহারী তখন ব্রাদার্স গ্রিমের মাহরচেন, দাসেন্টের নর্স টেলস, পাওয়েল অনুবাদিত আর্নাসনের আইসল্যান্ডিক গল্প, ক্যাম্পবেলের ইংরেজিতে করা হাইল্যান্ড স্টোরিজ এবং সংগৃহীত রূপকথা বা উপকথার কাছে অপরিচিত নন। তাই এর সংকলন হলে কেমন হবে, সেই ধারণা ছিল তাঁর।

লালবিহারীর বিশ্বাস ছিল, প্রাত্যহিক এই রূপকথা তুলনামূলক পৌরাণিক সাহিত্যেও অবদান রাখবে। কেবল তা-ই নয়, তুলনামূলক দর্শনকেও প্রভাবিত করবে। তিনি গঙ্গা-পাড়ের এই রূপকথা তুলে ধরলেন টেমস-তীরের ইংরেজদের কাছে। পেশ করলেন শম্ভুর মায়ের কাছ থেকে শোনা রূপকথার গল্পের সংবাদ। যা তিনি ছোট থেকে শতবার শুনেছেন। তবে এক মহাফাঁপরেও পড়েছিলেন। কোনো গল্পের লেজ অন্য গল্পের মাথার সঙ্গে আবার কোনোটার মাথা অন্য গল্পের লেজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আর বেশিরভাগটাই ভুলেও গিয়েছিলেন লালবিহারী দে। এর থেকে বাঁচার পথ একমাত্র শম্ভুর মায়ের কাছেই। কিন্তু খবর নিয়ে দেখা গেল, তিনি পঞ্চভূতে বিলীন। এবার খোদ শম্ভুকেই চিরুনি খোঁজা। জানা গেল, শম্ভুও গত। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গেমার গ্রেথেলের সন্ধান পান লালবিহারী। তিনিও তাঁর বৃদ্ধ ঠাকুরমার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছেন। গ্রেথেল একজন ভালো গল্পকারও। কিন্তু তাঁর স্টক খুব একটা বড় নয়। তাঁর কাছ থেকে দশটি গল্প শোনার পরে নতুন উৎসের সন্ধান করতে হয়েছিল লালবিহারী দে-কেই।

এর কিছুদিন পর একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ লালবিহারীকে দু’টি গল্প শোনালেন। তিনটি গল্প শুনিয়েছিলেন এক অভিজ্ঞ নাপিত। লেখকের একজন পুরনো ভৃত্য বলেছিলেন আরও দু’টি গল্প। আর বাকিটা তিনি শোনেন আরেক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কাছ থেকে। তাঁরা কেউ ইংরেজি জানতেন না। বাংলায় গল্প বলেছিলেন। লালবিহারী সেই গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এভাবেই একটা পূর্ণাঙ্গ বই, ‘ফোক-টেলস অব বেঙ্গল’ রূপ পায়; যে রূপকথার বয়স আজ একশো চল্লিশ ছুঁইছঁই।

রূপকথার বয়স প্রায় একশো চল্লিশ বললে এই সিদ্ধান্তে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। কারণ কোনো বই একশো চল্লিশ বছর আগে প্রকাশিত হলেই রূপকথার বয়স একশো চল্লিশ হবে কেন? এই মতকে বাঁচানোর চেষ্টা করব না মোটেও। বরং বলব, লেখক শম্ভুর মায়ের কাছ থেকে যে গল্পগুলো শুনেছেন, তা তো বহু আগেরই। সুতরাং একশো চল্লিশ বছরের সঙ্গে যুক্ত হবে ওই বছরগুলোও। এবার প্রশ্ন, শম্ভুর মা কোথা থেকে শুনেছেন গল্পগুলো? কেউ কি বলতে পারে মুরগি আগে না ডিম আগে এই ‘দর্শন’-প্রশ্নের উত্তর? মনে হয় এই ‘ফিলোসফিক্যাল কোয়েশ্চেন’টা ইমমর্টাল। অমর। রূপকথা অমরত্ব পায় ঠিক এখানেই। ঠিক যেমন ভাবে বলা হয়েছে আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আত্মা অমর— রূপকথাও তো তাই। সেই রাজা, সুয়োরানি, দুয়োরানির গল্প, তাঁদের দরবারে ভিখারির ভিক্ষা চাইতে আসা, ভিক্ষা দিতে না চাওয়া, রাক্ষস, খোক্কস, নীলকমল, লালকমল ইত্যাদি ছাঁচের মধ্যেই গল্প বলার পদ্ধতি চলে আসছে। জন্মের পর থেকে যে গল্পগুলো নারকেলের দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে দাদু-দিদার মুখে শুনেছি, সেগুলো তো আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে জন্ম-জন্মান্তর আগে। তাই কেবল রূপকথাই নয়, গ্রামীণ জীবনের ক্ষেত্রেও এই ‘অনন্তবাদ’ চিরপ্রযোজ্য। তবে গ্রামীণ জীবনকে কেবল কৃষক কিংবা শ্রমিক শ্রেণির নানান উপাখ্যানে বেঁধে ফেলা যায় না। আর যদি বেঁধে ফেলা হয়, তাকে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হবে। গ্রামকে ভাবতে হবে তার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও। তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে অভাবের জায়গাগুলো থেকেও। তাহলেই হয়তো সৃষ্টির ব্যুৎপত্তি বেরিয়ে আসতে পারে।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে তিনি লোককাহিনি সংগ্রহ করেছেন। মুখে শোনা গল্পগুলোর সংকলনই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। আমাদের পূর্বপুরুষদের সৃজনশীল সত্তা এতে পুনরুজ্জীবিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আর অন্যদিকে, লালবিহারী দে কৃষকজীবন ও গ্রামবাংলার জীবন নিয়ে ১৮৭৪ সালে লিখেছেন উপন্যাস ‘গোবিন্দ সামন্ত’। গ্রামীণ জীবনের এই বিবরণ পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন খোদ চার্লস ডারউইন। লালবিহারীকে চিঠিও লিখেছিলেন মুগ্ধতা জানিয়ে। আসলে সাংস্কৃতিকে জানতে গেলে উপকথাগুলোও জানা দরকার। শোনাও দরকার। কিন্তু সেইসব দাদু-দিদিমা-ঠাকুমাই তো হারিয়ে যাচ্ছেন।

সমস্ত উপকথার চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথম বৈশিষ্ট্য ‘প্রতীকবাদ’। উপকথার চরিত্রগুলোকে হতে হবে অ-মানব। এমনকী তাদের চালচলন মানুষের মতোই হতে হবে। এর প্রতীকী হিসেবে থাকবে সাহসিকতা। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ‘নৃতাত্ত্বিককরণ’। অর্থাৎ প্রধান চরিত্রগুলোকে (সেটা প্রাণীও হতে পারে), এমনকী জড় বস্তুগুলোকে মানুষের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলি দেওয়া হয়। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল ‘হাস্যরস’। কল্পকাহিনিগুলো বলা হয় মজাদার সুরে বা অনেকটাই ‘বোকার মতো’ ঢঙে। এর চূড়ান্ত বৈশিষ্ট্য, গল্পের শেষে সবসময় একটি নৈতিক উপদেশ থাকবে। যেমন, ‘কোনো দয়ার কাজ কখনও নষ্ট হয় না’ বা ‘ধীর-স্থিরভাবে দৌড়েও জয়লাভ করা যায়’ ইত্যাদি। উপকথাগুলোর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ঈশপ, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬২০ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন গ্রিক গদ্যকার। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে তিনি পশুদের ঘিরে অনেকগুলো উপকথা বা কল্পকাহিনি মুখে বলে গিয়েছিলেন। আধুনিক বিশ্বে এভাবেই অমর হয়ে রয়েছেন তিনি। ফরাসি উপকথকার জঁ দ্য লা ফোঁতেন (১৬২১-১৬৯৫) ঈশপে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কয়েকটি কল্পকাহিনি লেখেন, যা সেই সময়ে গির্জা এবং উচ্চশ্রেণির উপর ভিত্তি করে। তাঁর বিশ্বাস, একটি কল্পকাহিনির তার নৈতিকতার চারপাশে কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত। তাই নৈতিকতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, শিশু-জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক এই উপকাহিনি বা রূপকথা শোনা। বেড়ে ওঠার জন্য যে নৈতিক বুদ্ধি দরকার, তার অনেকটাই এই গল্পগুলো করে দেয়। আবার উপকথাগুলোকে একটি রাইটিং ইউনিটে অ্যাঙ্কর টেক্সট হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজস্ব রূপকথা লিখবে। কিন্তু এই মোবাইল, ইন্টারনেট সর্বস্ব দুনিয়ায় এমনটা হওয়া বেশ কঠিন। দোষটা শিশুদের নয়। এখন সিংহভাগ শিশু রূপকথা শুনে বাড়ে না। তাদের অভিভাবকরাও হয়তো রূপকথার গল্প জানেন না। এর থেকেই স্পষ্ট, অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে কয়েক দশক আগে থেকেই। অভিভাবকরা যখন শিশু ছিলেন, তাঁরাও রূপকথা শোনেননি আবার তাঁদের সন্তানদেরও রূপকথা স্বাভাবিক নিয়মে শোনার কথা নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তবে কী হবে? ১৯ শতকের দিকে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার অবিভক্ত বাংলার গ্রাম থেকে রাজা-রানি, রাক্ষস ও পরীদের মৌখিক লোককাহিনি সংগ্রহ শুরু করেছিলেন। এক শতাব্দী আগে গ্রামীণ জার্মানিতে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন গ্রিম ব্রাদার্স জ্যাকব এবং উইলহেলম। দক্ষিণারঞ্জনও গল্পের একটি ভাণ্ডার তৈরি করতে শুরু করেছিলেন, যেগুলো নথিভুক্ত এবং সংরক্ষণ না-করলে হারিয়ে যাবে। ভারতীয় সমাজের উপর ব্রিটিশ রাজের দমন-পীড়নকে মোকাবিলা করারও অন্যতম উপায় ছিল এটি। তাঁর এই সংগ্রহ এমন একটা সময়ে, যখন ঔপনিবেশিকতার আধারে পরিচিত জীবনধারাগুলো মুছে ফেলা হচ্ছিল। দাদু-দিদিমা-ঠাকুমাদের গল্পগুলোর মাধ্যমে শহুরে পাঠকরা ফিরে পাচ্ছিলেন তাঁদের পূর্বসূরীকেও। এখন ক্রান্তিকাল নেই। অবক্ষয়টা কিন্তু আছেই। ইন্টারনেট শিশুদের জীবন চিরতরে পরিবর্তন করার আগে এই ধরনের গল্প শুনে বড় হয়েছেন অনেকেই। তাঁদের অনেকেই এখনও জীবিত। রূপকথাগুলো শিক্ষারই একটা রূপ। তাই ভবিষ্যতের শিশুদের বৌদ্ধিক বিকাশের স্বার্থে লালবিহারী-দক্ষিণারঞ্জনের মতো কাউকে এগিয়ে আসতেই হবে।

Powered by Froala Editor