হ্যারি পটারের মতো বিশ্বজয় করতে পারে 'ঠাকুরমার ঝুলি'-ও, কিন্তু কীভাবে?


আজকাল এবং বহুকাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন জমায়েত উভয় ক্ষেত্রেই, একটি প্রশ্ন তথা খেদোক্তি বারবার উঠে আসে। এখনকার বাচ্চারা হ্যারি পটার পড়ে, কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলি পড়ে না কেন?
সেই নিয়ে দু-চারটে কথা বলা যাক।

প্রথম কথা, একটা বয়স পর্যন্ত শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব নির্বাচনের সুযোগ কম। অভিভাবকদের 'সাপ্লাই' অনুযায়ীই তাদের পাঠ-পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে, বাঙালি শিশুরা কেন এটা পড়ে কিন্তু ওটা পড়ে না, সে দায় কতটা তাদের, আর কতটা অভিভাবকদের, সেই প্রশ্নটি অবশ্যই বিচার্য।
দ্বিতীয় কথা, এমন জনগণের অনেকের কাছেই, মনে হয়, বাঙালি শিশুরা কী পড়ল না পড়ল সেটাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হচ্ছে, হ্যারি পটার সিরিজের মতো, আমাদের ঠাকুরমার ঝুলি আবিশ্ব পণ্যসাফল্য পেল না কেন। ক্লাসিকের সাথে আশৈশব পরিচয় নয়, ক্লাসিকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসাফল্য নিয়েই তাঁদের মূল মাথাব্যথা। হ্যাঁ, এটাই।


এবং তৃতীয় কথা, হ্যারি পটার আর ঠাকুরমার ঝুলিকে যাঁরা সমগোত্রীয় মনে করেন, তাঁদের সাহিত্যবোধ আদৌ অনুসরণেয় নয়।
এবার, দুয়ের তফাত নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
খুব সংক্ষেপে বললে, ঠাকুরমার ঝুলি হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট ভাষিক ভূখণ্ডে (অর্থাৎ অবিভক্ত বঙ্গদেশে) প্রচলিত ও কথকপরম্পরাক্রমে প্রবহমান কিছু কাহিনির এক একটি বিশেষ সংস্করণের, ব্যক্তিবিশেষকৃত (এক্ষেত্রে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারই সেই ব্যক্তি) সংকলন। পক্ষান্তরে, হ্যারি পটার সিরিজ হচ্ছে, সমগ্র বিশ্বের কল্পকথার বহুপ্রচলিত মোটিফ ও মিথগুলি সংগ্রহ করে, আধুনিক সময়ের পটভূমিতে লেখা উপন্যাসমালায় তাদের শিল্পসম্মত প্রয়োগ। লেখিকার গবেষণা, পরিশ্রম ও প্রতিভার মূল্য এখানে অপরিমেয়।
বলা চলে, ঠাকুরমার ঝুলি কিছুটা গ্রোথ এপিকের সঙ্গে তুলনীয়, আর হ্যারি পটার সিরিজ লিটারারি এপিকের সঙ্গে তুলনীয়।

গ্রোথ এপিক ব্যক্তিবিশেষের রচনা নয়, একটি বিশালব্যাপ্ত জাতির ঐতিহ্যবাহিত আখ্যান, যা নিয়ত পরিবর্তনশীল। কোনও সংকলক তার একটি বিশেষ পাঠকে সংকলিত করে রাখেন। ঠাকুরমার ঝুলির সংকলন-ক্রিয়ার সঙ্গে, গ্রোথ এপিকের সংকলন-ক্রিয়ার সাদৃশ্য এখানেই।


অন্যদিকে লিটারারি এপিক হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়পর্বে ব্যক্তিবিশেষের রচনা, যা গ্রোথ এপিকের ঐতিহ্যবাহিত নানা উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে। হ্যারি পটারের লিখন-ক্রিয়াটির সঙ্গে, লিটারারি এপিকের লিখন-ক্রিয়ার এই হল সাদৃশ্য।
ঠাকুরমার ঝুলি, আধুনিক পরিভাষায় বললে, কতকগুলি ছোটগল্পের সংকলন। গল্পগুলিকে 'Theme' অনুযায়ী 'দুধের সাগর', 'রূপ-তরাসী' ও 'চ্যাঙ ব্যাঙ' এই তিনটি খণ্ডে বিন্যস্ত করা হয়েছে বটে, কিন্তু একটি গল্পের সঙ্গে পরবর্তী গল্পের তেমন কোনও যোগসূত্র নেই। এগুলি পরস্পরবিচ্ছিন্ন ছোটগল্প, এবং ছোটগল্পের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী, খণ্ডোপজীবী।


অন্যদিকে, হ্যারি পটার সিরিজ পরস্পর-সম্পৃক্ত অবিচ্ছিন্ন উপন্যাসমালা। উপন্যাসের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী, তা সমগ্রোপজীবী।
ঠাকুরমার ঝুলি শিশুদের পঠনীয় এবং উপভোগ্য, বড়োদের কাছে তা মূলত গবেষণার বিষয়। অন্যদিকে হ্যারি পটার মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা হলেও, রচয়িত্রীর কলমের গুণে তা পরিণতবয়স্ক পাঠকেরও উপভোগ্য, এবং মানসিক পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে, বিদগ্ধ পাঠক এ উপন্যাসমালার নানা খণ্ডদৃশ্য থেকে নব নব তাৎপর্য খুঁজে পান, ও আস্বাদন করেন।


ঠাকুরমার ঝুলির নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে শিশু পাঠকের পূর্ণ একাত্মবোধ সম্ভব হয় না। কারণ, এক, সিংহভাগ ক্ষেত্রে এই চরিত্ররা ঘোরাফেরা করেন রাজ-পরিমণ্ডলে (এবং সে রাজ-পরিমণ্ডলের বর্ণনা অনাধুনিক ভারতে যদি বা সত্যাশ্রয়ী ছিল, বর্তমান বঙ্গদেশে তা দূর অতীতের স্মৃতি মাত্র)। দুই, এঁরা মূলত প্রাপ্তযৌবন বিবাহযোগ্য নরনারী। এবং তিন, তাঁদের 'Larger than life' কার্যকলাপের সঙ্গে শিশুর দৈনন্দিন যাপনের বিশেষ মিল নেই।
কিন্তু, হ্যারি পটার সিরিজের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। প্রথমত, হ্যারি-দুনিয়ায় বাস্তব জগত ও জাদু-জগত পাশাপাশি চলা দুই সমান্তরাল বহতা নদীর মতো, তাদের মধ্যে নিয়ত আদানপ্রদান চলে। দ্বিতীয়ত, মোটামুটি এগারো বছর থেকে শুরু করে টানা সাত বছর হ্যারির যে কৈশোরযাপন, তার সঙ্গে কিশোর পাঠকের নিত্যযাপনের প্রভূত মিল। কারণ, এ উপন্যাসমালার চরিত্রদের জাদু-ক্ষমতা যতই থাক, স্বভাবধর্মে তাঁরা আমাদের ইস্কুলের বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকা তথা স্বজনবর্গের থেকে খুব একটা আলাদা নন। তৃতীয়ত, নিতান্ত নিরানন্দ জীবন থেকে নন্দিত জীবনে হ্যারির যে উত্তরণ, তা কিশোর পাঠকদের চোখেও স্বপ্নের বীজ বোনে, তাই হ্যারি কিম্বা তার বন্ধুদের সঙ্গে তাদের একাত্মতা হয়ে ওঠে স্বচ্ছ ও সহজ।


তাই, ঠাকুরমার ঝুলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিলেও (সেই একান্ত বাঙালিয়ানায় ভরপুর বইটির অনুবাদে তার নিজস্বতা কতখানি রক্ষিত হবে, সেও এক ব্যাপার), তা কখনোই, হ্যারি সিরিজের সমগোত্রীয় হবে না। হতে পারে না।
তবে, এত মুষড়ে পড়ারও কিছু নেই।
মনে রাখবেন, ঠাকুরমার ঝুলি যেমন শিশুমনোরঞ্জনের জন্য মাতৃস্থানীয়া নারীদের কথন, হ্যারি পটারও, মূলগতভাবে তাই-ই। পুরনো গল্পের স্টক ফুরিয়ে গেলে আমাদের মা-মাসিরা যেমন রূপকথার বিভিন্ন উপাদান জোড়াতাড়া দিয়ে নতুন গল্প বানাতে এবং শোনাতে আরম্ভ করেন, রাওলিংও ঠিক তাইই করেছিলেন। নিজের শিশু-সন্তানদের গল্প শোনাতে গিয়েই রচয়িত্রী এই কাহিনিবীজ বপন করেছিলেন, কালে কালে তা মহীরূহ হয়েছে।
কীভাবে হল? ওই যে - গবেষণা, পরিশ্রম আর প্রতিভা!


সে কারণেই, রাওলিং অজস্র পাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে নানা দেশের কল্পজীবেদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, নির্মাণ করেছেন গূঢ়ার্থবহ অজস্র ল্যাটিন জাদুমন্ত্র। নিজের ডিপ্রেশনকে তিনি মূর্ত করেছেন আনন্দ-শোষক ‘ডিমেন্টর’ নামক কল্পজীবেদের মধ্যে। হিটলারসুলভ জাতিবিদ্বেষ চারিয়ে দিয়েছেন খলনায়ক ভোলডেমর্টের চরিত্রে। এরকমই অজস্র কালোত্তীর্ণ প্রতিভার সাক্ষর রয়েছে তাঁর লেখায়!


আচ্ছা, বাংলায় এই ধরনের গল্প লেখার চেষ্টা কি কেউই করেননি?
করেছেন, নিশ্চয়ই করেছেন। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়ো আঙলা’, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ – এইসব উপন্যাসেই বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে উপাদান নিয়ে লেখকেরা গড়ে তুলেছেন আশ্চর্য কল্পজগত। ব্যাঙের আধুলি, তালপাতার সেপাই, সুবচনীর খোঁড়া হাঁস, ‘আগডুম বাগডুম’ ছড়ার নানা চরিত্র ঘুরে বেড়ায় সেই সব কল্পজগতে। তবে, তাঁরা এই কল্পজগতকে ‘স্বপ্ন’ বলেই চিহ্নিত করেছেন, বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেননি। আর, ধারাবাহিক সিরিজও তাঁরা লেখেননি।


তাঁরা পথ দেখিয়ে গেছেন। সে পথে আরো এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব উত্তরকালের কথাকারদের।
বিবিধরত্নাকীর্ণ বঙ্গজননীর ভাণ্ডারে অদূর ভবিষ্যতে এমন কোনও নতুন মণি-মাণিক্য যে যোগ হবে না, এ কথা কি জোর দিয়ে বলা যায়?
হতেই পারে, কি বলেন?

Powered by Froala Editor