অরণ্য ধ্বংস করে ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প, প্রতিবাদে একজোট থাইল্যান্ডের বাসিন্দারা

একটা সময় চারিদিকেই ছিল সবুজের আচ্ছাদন। জলাভূমির ধারে হাজির হত বন্যপ্রাণ। আর আজ সেসবই ধ্বংসের মূলে। সভ্যতা যত আধুনিক হচ্ছে, যত নগরকেন্দ্রিক হচ্ছে, ততই হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। লোহা-লক্করের আওয়াজে মুছে যাচ্ছে পরিবেশ। ঠিক এরকমই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে থাইল্যান্ড। আর সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন বান বুন রিউয়েয়াং শহরের বাসিন্দারা।

থাইল্যান্ডের উত্তরের চিয়াং রাই এলাকা। একদিকে দোই ইয়াও পর্বতশ্রেণী, আরেকদিকে বয়ে যাচ্ছে ইঙ নদী। আর এই উপত্যকাতেই বহু প্রজন্ম ধরে বাস করছেন এই মানুষেরা। বান বুন রিউয়েয়াং-এই রয়েছে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। এবং থাইল্যান্ডের অন্যান্য জায়গার মতোই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। জীববৈচিত্র্যের জন্যই ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জায়গাকে বাঁচিয়ে রাখছে এখানকার বাসিন্দারা। এই গাছ, এই প্রাণীগুলো যেন আপনজন হয়ে গেছে। আর হবে নাই বা কেন! এরা আছে বলেই তো আমরা আছি… 

কিন্তু সময় সবার সমান যায় না। শিল্পবিপ্লবের পর একের পর এক কলকারখানার উদ্ভব হল বিশ্বের নানা জায়গায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গাড়ি তরতরিয়ে এগিয়ে গেল। সভ্যতাও আধুনিক হল, নগরসভ্যতার বিবর্তন হল। আর এর ফল ভুগতে হল পরিবেশকে। একের পর এক বনজঙ্গল ধ্বংস হতে শুরু করল। প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশিই এর পরিমাণ। আর এই ঢেউ চলে এল থাইল্যান্ডেও। ১৯৬১ সালেও যেখানে সবুজের পরিমাণ ছিল ৫৩ শতাংশ, বিংশ শতকের শেষে তার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫ শতাংশে। ঘন জঙ্গল তো বটেই; বিশেষ করে জলাভূমিগুলো বিপদের মুখে পড়ল। নদীর ধারে বলে তৈরি হল আধুনিক শহর, তৈরি হল কারখানা, কৃষিজমি। আর বিপদে পড়ল সেখানকার পরিবেশ। 

ঠিক একই ঘটনা ঘটল বান বুন রিউয়েয়াংয়ে। ২০১৫ সাল। থাইল্যান্ড সরকারের তরফ থেকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের কথা ঘোষণা করা হল। এই জলাভূমি-সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হল। প্রায় ১২০০ একর বিস্তৃত এই অঞ্চলটির সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্রের কথা কেউ ভাবলও না। লক্ষ্য তখন একটাই, কেবল এবং কেবলমাত্র কারখানাই তৈরি করতে হবে। বিদেশি লগ্নি আনতে হবে। তাহলেই পুঁজি বাড়বে। এদিকে জনসংখ্যাও তো বাড়ছে। তাঁদেরকেও তো সুযোগ দিতে হবে… 

কিন্তু ইঙ ও মেকং নদীর ধারের এই অঞ্চলের গঠনতন্ত্র নষ্ট হয়ে গেলে কি আর ফেরত পাওয়া যাবে! ইতিমধ্যে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু সমস্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে এখানকার জীবজগত। আর এই কাজটি হলে তো… না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আন্দোলনে নামলেন বান বুন রিউয়েয়াংয়ের বাসিন্দারা। এত বছর ধরে তাঁরা এখানকার ভূমিপুত্র; কী করে মেনে নেবে এমনটা? স্রংপোল চান্থারুয়েয়াং-এর নেতৃত্বে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শুরু হল বিদ্রোহ। পরিবেশ রক্ষা করতেই হবে, সে যে কোনো মূল্যেই হোক। এসব যে আমাদেরই ঘরবাড়ি… 

শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে চিয়াং রাই অঞ্চলের প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বিশেষ প্রোজেক্টটি বাতিল করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বনাঞ্চল, জলাভূমিকে কখনই নষ্ট করা যাবে না— এই দাবি কার্যত মেনে নিয়েছে তাঁরা। আর এটাই বান বুন রিউয়েয়াংয়ের সবচেয়ে বড়ো জয়। তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। ২০২০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ পুরস্কার ‘ইকুয়েটর প্রাইজ’ পেয়েছেন তাঁরা। তবে এখনও থামেনি তাঁদের কাজ। এখনও লড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। নতুন করে বাঁধ তৈরির কথাও এখন ভাবা হচ্ছে ওই অঞ্চলে। যার জেরে আবারও আন্দোলনে নেমেছে বান বুন রিউয়েয়াং। যতবার পরিবেশের ওপর আঘাত আসবে, ততবারই তাঁরা আওয়াজ তুলবেন— এটাই দাবি… 

আরও পড়ুন
চোরাশিকার ঠেকেছে শূন্যে, সম্বলপুর বনভূমির ‘ত্রাতা’ ১৫ জন মহিলা

Powered by Froala Editor