আদরের ছেলে দূর বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসেছেন মা বাবা। ঠিক সেই সময়ে সেনাবাহিনীর পোশাকে এক বলিষ্ঠ যুবকের অকুস্থলে প্রবেশ, মায়ের মুখে প্রশ্নচিহ্ন। মায়ের ছটফটানি আরও বেড়ে গেল, যখন তিনি দেখলেন সেই যুবক তাঁর ছেলেকে কেবল জড়িয়ে ধরেই ক্ষান্ত হল না, তার কপালে এঁকে দিল বিদায়ী চুম্বনের রক্তরাগ। মায়ের কাঁধে সস্নেহে চাপ দিলেন বাবা, শান্ত হতে ইঙ্গিত করলেন। অভিজ্ঞ মানুষটি কথা না বলেই বুঝিয়ে দিলেন, এ তো স্বাভাবিক, এ তো সুন্দর। এ নিয়ে ব্যস্ত হবার কী আছে?
এমনই এক ব্যতিক্রমী, অথচ সহজ-সুন্দর প্রেমের গল্প শোনায় থাইল্যান্ডের ওয়েব সিরিজ 'নি-থান ফান দাও', ওরফে, হাজার তারার গল্প।
'নি-থান ফান দাও' ওরফে 'এ টেল অব থাউজ্যান্ড স্টারস’ - থাই ভাষার এই ওয়েব সিরিজটি পরিচালনা করেছেন নোফ্রার্নাচ চাইউইমাল, মূল ভূমিকায় আছেন পিরাপাত ওয়াত্থানাসেৎসিরি (ফুফা) এবং সাহাফাপ ওংগ্র্যাছ (টিয়ান)। 'ব্যাকটেরিয়া' ছদ্মনামে প্রসিদ্ধ এক লেখকের উপন্যাস এই সিরিজের মূল অবলম্বন। ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ২ এপ্রিল অবধি GMM 25 এবং LINE TV প্রতি শুক্রবার এই সিরিজের একটি করে পর্ব দেখিয়েছে। দশটি পর্বে বিন্যস্ত এই আখ্যান অন্তর্জালের কল্যাণে কিছুদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতির তুঙ্গ শিখরে পৌঁছেছে।
এইখানে এই সিরিজের গল্পটি অল্প কথায় বলে নেওয়া যাক। থাইল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্রে রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী ধনকুবের বাপের আদরের ছোটো ছেলে টিয়ান- প্রবল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেরে ওঠার পরে টিয়ান জানতে পারে, হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তার আরোগ্য সম্ভব হয়েছে। নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে সে খুঁজে বের করে, ফু ফান ডাও গ্রামের অকালমৃত স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষিকা টোরফানের হৃদয়ই তাকে দিয়েছে নতুন জীবন। নিজের প্রাণদাত্রীর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায়, তার ঋণশোধের উদ্দেশ্যে টিয়ান নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষকের চাকরি নিয়ে পাড়ি দিল ফু ফান ডাও গ্রামের প্রত্যন্তভূমিতে। এখানেই তার জীবনে আসে সেনাধ্যক্ষ ফুফা, ঘটনাচক্রে যে আবার টোরফানের প্রার্থিত পুরুষও বটে। ফুফা ও টিয়ানের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা ও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে ক্রমে জন্ম নেয় গভীর প্রেম। বন্ধুদের অকুণ্ঠ সহযোগ, এবং নানা বাধাবিপত্তি থেকে ক্রমাগত উত্তরণের মাধ্যমে, বিচিত্র ঘটনার বুননে তাদের সম্পর্ক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।
আরও পড়ুন
নির্বাক যুগেও একটি সিনেমার আয় সাত লক্ষ টাকা, নেপথ্যে হাওড়ার জ্যোতিষচন্দ্র
এবার আসা যাক, এই আখ্যানের বিশেষত্বের কথায়।
আরও পড়ুন
সমপ্রেমের সিনেমা, সমকামী অভিনেতাকে নিয়েই ‘বাজিমাত’ হলিউডের
বাংলা ভাষায় বিগত কয়েক বছর ধরে বিকল্প যৌনতা নিয়ে যে শিল্পচর্চা হয়ে চলেছে, সেখানে দেখা গেছে সংঘাতের প্রাধান্য। এই সংঘাত, সংখ্যালঘু 'কুইর' গোষ্ঠীর সঙ্গে তথাকথিত স্বাভাবিক সংখ্যাগুরু বিষমকামী গোষ্ঠীর সংঘাত। পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের সামনে সমকামী এবং রূপান্তরকামী চরিত্রদের আত্মপ্রকাশ এবং স্বেচ্ছাবিহারে যে সমস্ত সমস্যার সামনে পড়তে হয়, মূলত সেই পারস্পরিক বিবাদ নিয়েই গড়ে উঠেছে এই সব শিল্পনিদর্শন- তা সে সাহিত্য হোক, বা ছবি, অথবা চলচ্ছবি। এবং, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে আখ্যানের পরিণতি বিয়োগান্ত, করুণ। এই ধরনের শিল্প-নিদর্শনে অভ্যস্ত বাঙালির সামনে, ‘এ টেল অব থাউজ্যান্ড স্টারস' নিঃসন্দেহে এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে আনবে।
আরও পড়ুন
প্রথম কোনো ভারতীয় সিরিজ হিসাবে এমি পুরস্কার জয় ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর
এখানে দুই নায়ক ফুফা এবং টিয়ান- তাদের সমকামী প্রবৃত্তি নিয়ে আশেপাশের কারোর সঙ্গেই তেমন কোনও সমস্যা, সঙ্কোচ বা সংঘাত ঘনিয়ে উঠছে না। ঘটছে ঠিক তার উলটো ব্যাপার, আশেপাশের বন্ধুরাই তাদের আত্মপ্রকাশ এবং সম্পর্কের অগ্রগতি ঘটানোর ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ফুফার বন্ধু ডক্টর নাম-এর অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও সুপরামর্শে কথা। যোদ, র্যা ঙ, লংটেই প্রভৃতি বন্ধুরা কখনও হাসিঠাট্টা, কখনও সান্ত্বনা, কখনও সহর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে যেভাবে এই দুটি মানুষের প্রেমকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুঘটক হয়ে উঠেছে, তা এক কথায় অপূর্ব। গ্রামের ভূয়োদর্শী মোড়ল খামা, এবং টিয়ানের উদারপন্থী বাবার সস্নেহ ভূমিকার কথাও এখানে স্মরণীয়। আমাদের বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে বিষমকামী বন্ধু তুল-এর কাছে টিয়ানের নিজস্ব যৌনপ্রবৃত্তি স্বীকার করার দৃশ্যটির কথা। তুল-এর প্রতিক্রিয়া এক্কেবারে স্বাভাবিক - সে বলছে - আমি কুকুর ভালোবাসি আর তুই বেড়াল পছন্দ করিস, এটা তো ঠিক এরকমই একটা ব্যাপার! এ নিয়ে অত চিন্তার কী আছে!
গল্পের পটভূমি নির্মাণের ক্ষেত্রেও নির্মাতারা দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেনাছাউনিতে উপযুক্ত সঙ্গিনীর অভাবে বাধ্যতামূলকভাবে সমলৈঙ্গিক যৌনতার অভ্যাস, আর সেই উপলক্ষ্যে দুর্বলের ওপর প্রবলের অত্যাচার- এই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার কথা অনেকেরই জানা। অথচ এই পটভূমিতেই নির্মাতারা বানালেন একটি আদ্যন্ত প্রেমের গল্প- যেখানে সমকামের কারণ সঙ্গিনীর অভাব নয়, যেখানে কোনও অবাঞ্ছিত বলপ্রয়োগ নেই; আছে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা; আছে প্রতীক্ষা ও সংযমের তপস্যা। বহুগামিতার বিস্ফোরণের যুগে একনিষ্ঠতার এমন জয়ধ্বনি আমাদের বিস্মিত করে, আপ্লুত করে। এই একনিষ্ঠতার প্রতীক হিসাবেই এই চলচ্ছবিতে উঠে এসেছে একজোড়া হর্নবিল প্রজাতির আজীবন একনিষ্ঠ পাখির খণ্ডচিত্র, যা দেখে ভারতীয় মননে অব্যর্থভাবে ভেসে ওঠে আদিকাব্যের ক্রৌঞ্চমিথুনের স্মৃতি।
এই আখ্যানের আলোচনায় একটি স্বপ্নদৃশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের শয্যায় অচেতন টিয়ান স্বপ্ন দেখছে - চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার - তার মধ্যে একটুকরো আলো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অপরিচিতা টোরফান। টোরফান ক্রমে এগিয়ে আসে, কোমল হাতের আলতো স্পর্শ রাখে টিয়ানের বুকে, ফিসফিস করে বলে - যা পেলে, যত্নে রেখো। তারপরেই বিস্মিত টিয়ানের মুখোমুখি হয় ফুফা - তার আয়ত চোখের প্রেমমুগ্ধ চাহনিতে টিয়ানের শরীরে-মনে জাগে কম্পন - স্বপ্ন যায় ভেঙে...
আমাদের মতে, এই স্বপ্নদৃশ্য আদ্যন্ত রূপক। পুরুষ-শরীরী টিয়ানের বুকের মধ্যে যে অন্তর্গূঢ় নারীত্ব এতকাল গোপন ছিল, টোরফানের হৃদয় নিজের মধ্যে লালন করতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে তার জাগরণ আরম্ভ হয়, আর ফুফার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যাপনের মাধ্যমে কোরকের অবশিষ্ট আবরণটুকুও ঘুচে গিয়ে ঘটে পূর্ণ সূর্যালোকে মাধবীর আত্মপ্রকাশ।
টোরফানের মৃত্যুও কি সত্যিই দেহজ অস্তিত্বের অবসান? পরিচালক কিন্তু একবারও টোরফানের আহত কিংবা মৃত শরীর দেখাননি। সম্ভবত, এই মৃত্যু আসলে প্রত্যাখ্যাত টোরফানের আত্ম-অপসারণের প্রতীক - অসীম উদারতায় যে নিজের স্থানটুকু নিঃসঙ্কোচে টিয়ানকে উৎসর্গ করে গেছে। অন্তরে টোরফানের হৃদয়, আর বাইরে তার দিনলিপির তথ্য - এই দুইয়ের মাধ্যমে টোরফানই হয়ে উঠেছে টিয়ানের পরবর্তী জীবনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রী। তবে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর টিয়ান শেষপর্যন্ত টোরফানের ডায়েরিটিকে সমাধিস্থ করেছে। সে বেছে নিয়েছে নতুন জীবন - যেখানে সে টোরফানের প্রতিস্থাপিত বিকল্প মাত্র নয়, সে নিজের সবটুকু নিজস্বতার আলোয় উজ্জ্বল।
একেবারে শেষে, বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে এ ছবির নায়কমিথুনের অনবদ্য অভিনয়ের কথা। আর্থ' এবং 'মিক্স' - ডাকনামে বিখ্যাত দুই অভিনেতা যেভাবে নিজেদের সমস্ত প্রতিভাটুকু এই সিরিজে নিংড়ে দিয়েছেন, তার তুলনা নেই। এর আগেও তাঁরা একসঙ্গে অনেক চলচ্ছবির প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে জনপ্রিয়তার তুঙ্গশীর্ষে তাঁদের আরোহণ ঘটেছে এই হাজার তারার গল্প বলার সূত্রেই। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে শিল্প-জগতে সমপ্রণয়ী মিথুন হিসাবে তাঁদের এই যে আশ্চর্য উত্থান, তা নিশ্চয়ই সমগ্র পৃথিবীর কুইর মুভমেন্ট-এর ইতিহাসে এনে দেবে আরও খানিকটা আলো, আরও খানিকটা টাটকা বাতাস। আমরা প্রতীক্ষা করব সেই পৃথিবীর জন্য, যেখানে সংখ্যালঘু প্রেম অথবা যৌনতা 'অস্বাভাবিক' বা 'অসাধারণ' কোনোটাই নয় - আর পাঁচটা সম্পর্কের মতোই তা নিতান্ত সহজ, স্বচ্ছন্দ এবং সুন্দর। যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ সগর্বে বলতে পারে,
"পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।"
Powered by Froala Editor