মরচে ধরছে খোদ আইফেল টাওয়ারে!

১৮৮৯ সাল। স্থপতি গুস্তাভ আইফেলের তত্ত্বাবধানে প্যারিসের বুকে গড়ে উঠেছিল এক আশ্চর্য সৌধ। যার উচ্চতা প্রায় ৩২৪ মিটার। সাত হাজার টন লোহা দিয়ে তৈরি হয়েছিল প্রকাণ্ড এক আকাশচুম্বী মিনার— আইফেল টাওয়ার (Eiffel Tower)। কথা ছিল মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই আবার খুলে ফেলা হবে লোহার বাঁধন। ভেঙে ফেলা হবে এই টাওয়ারকে। কিন্তু একশো তিরিশ বছর পর আজও প্যারিসের বুকে দণ্ডায়মান আইফেল। প্যারিস বা ফ্রান্স তো বটেই, গোটা ইউরোপের অন্যতম ঐতিহ্য এই টাওয়ার। তবে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণে কতটা কার্যকরী ফ্রান্স প্রশাসন? এবার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আনল ফরাসি সংবাদপত্র ‘মারিয়ানে’।

সম্প্রতি ‘মারিয়ানে’-তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভয়াবহ অবস্থা আইফেল টাওয়ারের। গোটা টাওয়ারটিকেই নাকি ধীরে ধীরে গিলে ফেলছে মরচে। এমন চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে পড়তে পারে আস্ত টাওয়ারটি। তা সত্ত্বেও টাওয়ার মেরামতির কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না ফ্রান্স সরকার। কেবলমাত্র ২০২৪-এর প্যারিস অলিম্পিকের কথা মাথায় রেখে ‘কসমেটিক মেক-আপ’ চড়ানো হচ্ছে আইফেলের গায়ে। 

না, শুধু ফরাসি পত্রিকার দাবি নয়। আইফেল টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত একাধিক আধিকারিকও প্রশ্ন তুলেছেন আইফেলের স্বাস্থ্য নিয়ে। নাম প্রকাশ না করেই বেশ কিছু কর্মী জানিয়েছেন, টাওয়ারের এই অবস্থা দেখলে স্থপতি গুস্তাভ আইফেল স্বয়ং নাকি হৃদরোগে আক্রান্ত হতেন। 

প্যারিসের অন্যতম ঐতিহ্য আইফেল টাওয়ার তৈরি হয়েছিল পুডল আয়রন দিয়ে। আঠারো-উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের সময় এই বিশেষ লোহার উদ্ভাবন ও ব্যবহার শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপেই। সাধারণ কাঁচা লোহা বা পিগ আয়রনকে গলিয়ে, তার থেকে কার্বন অপসারণ করে তৈরি করা হত প্রায় ১০০ শতাংশ বিশুদ্ধ, হাই-গ্রেড লোহা। সেটাই মূলত পুডল আয়রন। ফলে, তাতে মরচে বা জং ধরা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। টাওয়ার তৈরির পর তাই ২০ বছরের মধ্যে এই টাওয়ার ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন গুস্তাভ স্বয়ং। যদিও মরচে প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট বন্দোবস্তও করেছিলেন তিনি। 

আরও পড়ুন
আইফেল টাওয়ার নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে কল্কি কেঁকলার পূর্বপুরুষ!

তৎকালীন সময়ে জিঙ্ক কোটিং বা গ্যালভানাইজিং-এর পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে ভালো ক্ষয়রোধী এবং মরচে প্রতিরোধী পদার্থ ছিল রেড-লেড পেইন্ট। আইফেল টাওয়ারকে দীর্ঘজীবী করে তুলতে ৪টি আস্তরণে রেড-লেডের রং করা হয়েছিল তার গায়ে। তবে গুস্তাভ সতর্ক করেছিলেন এই রং-এর প্রলেপও যথেষ্ট নয়। প্রতি ৬ বছর অন্তর পুরনো রং-এর আস্তরণ সরিয়ে নতুন করে রং করতে হবে এই টাওয়ারে। 

আরও পড়ুন
আইফেল টাওয়ার পছন্দ নয়, প্যারিস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মঁপাসা

বিগত ১৩৪ বছরের হিসেব বলছে, এখনও পর্যন্ত মোট ২০ বার রং করা হয়েছে আইফেলে। দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় বিলম্বিত হয়েছিল আইফেলের রক্ষণাবেক্ষণ। ২০২০ সালে আইফেলে রং করার কথা থাকলেও, মহামারীর জন্য বাতিল হয়ে যায় সংরক্ষণ প্রকিয়া। তারপর মহামারীর রেশ কমলেও, টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন। যদিও, ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের জন্য আইফেল টাওয়ার রং করার জন্য ৬০ মিলিয়ন ইউরোর তহবিল বরাদ্দ করেছে ফরাসি সরকার। তবে তা দিয়ে কেবলমাত্র দু-কোট রং-এর প্রলেপ করা হবে। টাওয়ার কর্মীদের বক্তব্য, পুরনো রং-এর আস্তরণ না ছাড়িয়েই রং-এর প্রলেপ লাগানোয় টাওয়ারের গায়ে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে সীসার পরিমাণ। সেইসঙ্গে মরচে পড়ছে টাওয়ারে। 

অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা দরকার এই টাওয়ার। সেটিও করতে নারাজ আইফেলের তত্ত্বাবধানে থাকা ‘সিটি’ সংস্থা। প্রতি বছর ৬০ লক্ষ পর্যটক ভিড় জমান এই টাওয়ার পরিদর্শন করতে। সেই রাজস্ব বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেই টাওয়ার খোলা রাখার সিদ্ধান্ত ‘সিটি’-র। তবে এভাবেই চলতে থাকলে গোটা প্যারিস বিপদের সম্মুখীন হবে, ক্রমশ প্রকট হচ্ছে সেই আশঙ্কাই…

Powered by Froala Editor