নদী, পাহাড়, বিস্তীর্ণ জমি— এমনই ছিমছাম জায়গার ছবি দেখে ঘুমোতে গেলেন। হঠাৎই সকালবেলা উঠে দেখলেন, পুরো ছবিটা বদলে যাচ্ছে। রাতারাতি ফাঁকা হয়ে গেছে জায়গাটি। কোথা থেকে অনেক নতুন মুখ এসেছে। তৈরি হচ্ছে বড়ো বড়ো বাড়ি। কিন্তু হলটা কী? এই প্রশ্ন করলেও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সবার মুখেই কুলুপ! যতটা সম্ভব কম কথা বলছেন তাঁরা। এমন সিনেম্যাটিক দৃশ্যেরই সাক্ষী থেকেছিল আমেরিকা। কিন্তু সেই দৃশ্যের পেছনে রহস্যটি কী? চলুন এগোনো যাক…
প্রায় ৬,০০০ একরের বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা বলা ভুল, সেখানে রয়েছে চাষের জমি। এই বিশাল জায়গায় বসবাস মাত্র তিন হাজার পরিবারের। বেশিরভাগই কৃষিজীবী। এক নজর দেখলে, কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না এই জায়গার। মানুষগুলো নিরিবিলিতে চাষ করছে, দিনের শেষে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে; ব্যস এইটুকুই। সেই চিত্রটাই বদলে গেল হঠাৎ আসা নোটিসে।
কীসের নোটিস? জায়গা ছেড়ে দেওয়ার। তিন হাজার পরিবারকে রাতারাতি জায়গা দেওয়ার কথা বলা হল আমেরিকা সরকারের তরফ থেকে। কেন, কী বৃত্তান্ত, কিচ্ছু বলা হল না। পরিবাররা ছাড়তে বাধ্য হল, প্রশাসন বলেছে যে! কৌতূহল সবারই হয়েছিল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। সেই দিন থেকেই ওক রিজের ওপর নজর পড়ল সবার। হ্যাঁ, এই বিস্তীর্ণ জায়গাটির এমনই নাম দিয়েছিল প্রশাসন।
সময়টা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক। আরও ভালো ভাবে বললে, ১৯৪৩-এর আশেপাশে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। এই সময়ই জন্ম ওক রিজের। গাছগাছালিতে ঘেরা ফাঁকা জায়গাটি রাতারাতি বদলে গেল। তৈরি হতে লাগল বাড়ি, ঘর, কারখানা। বাইরে থেকে মানুষরা আসতে লাগল। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এদের বেশিরভাগেরই বয়স তিরিশের কোঠায়। মাত্র ছয় মাসে তৈরি হল আস্ত একটা শহর। বাইরে থেকে দেখলে, সেই সময়ের আধুনিক শহরের সব উপকরণই আছে। রয়েছে হোটেল, রেস্তোরাঁ, বার, থিয়েটার, লাইব্রেরি ইত্যাদি সব আয়োজন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু তো অন্যরকম চলছে। কারণ, অনুমতি ছাড়া কাউকে ওর ভেতর ঢুকতে দেওয়া হত না। এমনকি, কী কাজ চলছে, সে সম্পর্কে ওক রিজেরও খুব কম লোক জানতেন। কারা জানতেন, সেটাও কেউ জানত না! বাইরের জগতের সঙ্গে রেল বা সড়কপথে যোগাযোগ তো রয়েছে; কিন্তু সবই ছিল কঠোর দৃষ্টির নিচে। ম্যাপেও ওক রিজের কোনো অস্তিত্ব ছিল না!
কিন্তু হচ্ছিলটা কী? এর সম্পর্কেও নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। একে যুদ্ধের পরিস্থিতি, তার ওপর এমন গোপনীয়তা; হয়ত কোনো মিলিটারি অনুশীলন হচ্ছে! কেউ কেউ এমনও বললেন, এটা নাকি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের গোপন শিবির। এখান থেকেই ভোট পরিচালনা করবেন তিনি! কিন্তু সবই ছিল গুজব। আসলে কী হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। আশেপাশের বাসিন্দারা দেখছেন, ওক রিজের গেট দিয়ে বিশাল বিশাল গাড়ি, যন্ত্র, বড়ো বড়ো ট্রাঙ্ক ভেতরে যাচ্ছে। কিন্তু একটি জিনিসও বাইরে আসেনি। তার সঙ্গেই ছিল ভেতরের রহস্যজনক বিশাল ‘ইউ’ আকৃতির একটি কমপ্লেক্স। দেখে কারখানাই মনে হচ্ছে, কিন্তু সেখানে কী হচ্ছে? উত্তর নেই। ১৯৪৩-এ যার শুরু হয়েছিল, সেখানে তিন বছর যেতে না যেতেই জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ৭৫ হাজারে।
অবশেষে এল ১৯৪৫ সাল। আগস্ট মাস। আমেরিকার বিমান উড়ে গেল জাপানের হিরোশিমা শহরের দিকে। তার তিনদিন পর, নাগাসাকিতে। দুই জায়গাতেই ফেলা হল পারমাণবিক বোমা। সেই প্রথম বিশ্ব দেখল পরমাণু বোমার ভয়াল কীর্তি। সেই সঙ্গে সামনে এল ওক রিজের রহস্য। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের নাম তো সবাই শুনেছেন। যে প্রোজেক্ট জন্ম দিয়েছিল পারমাণবিক মারণাস্ত্রের। এই ওক রিজেই চলত সেই কার্যকলাপ। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের জন্মস্থান হল এই জায়গাটি। গোটা বিশ্বের সামনে যাতে কোনোভাবেই প্রকাশ্যে না আসে, তার জন্যই এত গোপনীয়তা। কিন্তু এই নিরিবিলি জায়গাটিকেই কেন বাছা হয়েছিল? ধারণা করা হয়, আমেরিকার অন্যান্য অংশের থেকে তুলনায় কম মানুষের বাসস্থান এখানে; এবং প্রাকৃতিকভাবে এমনিই খানিক আলাদা। সেইসঙ্গে সড়কপথেও যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। এটাকেই একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিজের মতো করে নিল আমেরিকা সরকার। বাকিটা, ইতিহাস! তবে শেষ পর্যন্ত গোপনীয়তা কিন্তু বজায় ছিল। কেউ জানতেও পারেনি ওক রিজের সম্পর্কে। পারমাণবিক বোমার রহস্য এত সহজে বলা যায় নাকি!
Powered by Froala Editor