জ্যান্ত বিড়াল দিয়ে তৈরি টেলিফোন! চমকে দিয়েছিলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী

চোখের পলকে হাতে ধরে থাকা ফুলের তোড়া বদলে যাচ্ছে জীবন্ত পায়রায়। আবার কখনও হেঁটে-চলে ঘুরে বেড়ানো গিনিপিজ হয়ে যাচ্ছে রুমাল। এমন আশ্চর্যকর দৃশ্য হামেশাই চোখে পড়ে ম্যাজিকের জগতে। কিন্তু সত্যিই কি কোনো জীবন্ত প্রাণী বদলে যেতে পারে যন্ত্রে? এমনটাই করে দেখিয়েছিলেন দুই খ্যাতনামা মার্কিন ব্যক্তিত্ব। জীবন্ত বিড়ালকে বদলে ফেলেছিলেন টেলিফোনে। না, কোনো ম্যাজিক প্রদর্শনী কিংবা অলৌকিক ক্ষমতার গল্প নয়, একেবারে নিখাদ বিজ্ঞানকথা।

শুরু থেকেই বলা যাক তবে। ১৯২৯ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে গবেষণারত কিংবদন্তি বিজ্ঞানী আর্নেস্ট গ্লেন ওয়েভার। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর সহকারী অধ্যাপক চার্লস উইলিয়াম ব্রে। অডিটারি নার্ভ বা শ্রুতিস্নায়ু ঠিক কীভাবে কাজ করে— সেই রহস্যের সমাধান করতেই এক অদ্ভুত পরীক্ষার কর্মসূচি নিলেই এই দুই মার্কিন গবেষক। ঠিক হল জীবিত কোনো প্রাণীর শ্রুতিস্নায়ু মস্তিষ্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হবে, তা আদৌ কার্যকর থাকছে কিনা। 

যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। কয়েকদিনের মধ্যেই তোড়জোড় শুরু হল পরীক্ষার। আর সেই পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হল উইলিয়াম ব্রে-র পোষ্য বিড়ালই। উচ্চমাত্রার ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, খুলে ফেলা হল তাঁর মাথার খুলি। তারপর শ্রুতিস্নায়ু মস্তিষ্কের লোব থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর তারের মাধ্যমে তা জুড়ে দেওয়া হল একটা টেলিফোন রিসিভারের সঙ্গে। ফলে খোদ বিড়ালের শ্রবণেন্দ্রিয়ই হয়ে উঠল ট্রান্সমিটার। তবে যতটা সহজভাবে এই গল্প বলা, আদতে গোটা প্রক্রিয়াটাই ছিল ততোধিক জটিল। 

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবেই সফল হয় দুই মার্কিন গবেষকের এই পরীক্ষা। বিড়ালের কানের কাছে ওয়েভার কথা বলার পর, সেই শব্দ প্রায় ৫০ মিটার দূরে একটি সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে বসেই টেলিফোনে শুনতে পান উইলিয়াম ব্রে। এরপর দ্বিতীয়বার এই পরীক্ষা নিশ্চিত করতে বন্ধ করে দেওয়া হয় বিড়ালের শ্রুতিস্নায়ুর রক্তচলাচল। তারপর আর সংযোগ পাওয়া যায়নি টেলিফোনে। মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সঙ্গে টেলিফোনের তার জুড়েও, এমন পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন ব্রে এবং ওয়েভার। ব্যর্থ হয় প্রচেষ্টা। তবে এটুকু বোঝা গিয়েছিল যে শ্রবণস্নায়ু কেবলমাত্র শব্দকে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়, কিন্তু আসল শব্দ রিসিভারের কাজ করে কানের মধ্যে অবস্থিত বিশেষ হাড়ের সজ্জা ও দেহাংশ। 

আরও পড়ুন
কী আছে পৃথিবীর পেটের ভিতর? গর্ত খুঁড়লেন বিজ্ঞানীরা, তারপর...

দুই মার্কিন গবেষকের এই গবেষণা সেসময় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। ‘ক্যাট-টেলিফোন’-এর খবর ছাপা হয়েছে প্রায় সমস্ত অগ্রগণ্য পত্রিকায়। বাদ থাকেনি বিতর্কও। সমাজকর্মী এবং প্রাণী অধিকার কর্মীরা গর্জে উঠেছিলেন এমন পরীক্ষার প্রতিবাদে। তবে তা সত্ত্বেও দুই বিজ্ঞানীর এই গবেষণাকে সম্মান জানিয়েছিল সোসাইট অফ এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিস্টস। উল্লেখ্য, তাঁরাই প্রথম হাওয়ার্ড ক্রসবি ওয়ারেন পদকের সম্মাননা পান। 

অবশ্য তাঁদের এই গবেষণার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রথম শ্রুতিস্নায়ুর ব্যবচ্ছেদ ও তার সঙ্গে অন্য কোনো যন্ত্রের সংযোগের এই প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করেই পরবর্তীতে ককলিয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের ধারণা পান গবেষকরা। শ্রবণশক্তি পুনরুদ্ধারে যা আজও অন্যতম হাতিয়ার চিকিৎসকদের। আশ্চর্যের বিষয় হল, এখনও অপরিবর্তিতভাবেই ব্যবহার করা হয় ওয়েভারের স্নায়ু-সংযোজন প্রক্রিয়াটি। 

আরও পড়ুন
মহাকাশে জন্ম নিল ব্যাকটেরিয়া, ভারতীয় বিজ্ঞানীর নামে নামকরণ

তবে শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞান বা প্রাণীবিদ্যাই নয়, এই পরীক্ষা প্রমাণ দিয়েছিল পদার্থবিদ্যারও এক প্রাচীন তত্ত্বের। সেই সময় মনে করা হত, শব্দের কম্পাঙ্ক বাড়লেই প্রাবল্য বৃদ্ধি পায়। এমনটা তত্ত্বে থাকলেও, ততদিন তার কোনো যথাযথ প্রমাণ দিতে পারেননি পদার্থবিদরা। ক্যাট-টেলিফোনের মাধ্যমে সেই রহস্যেরও যবনিকাপতন হয়েছিল।

তবে এরপর আর খুব বেশিদিন প্রথাগত গবেষণা চালিয়ে যেতে পারেননি দুই গবেষক। ততদিনে দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সেসময় ব্রে ও ওয়েভার দু’জনেই কাজ করেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে। ওয়েভার ছিলেন নেভির সাবমেরিন প্রতিরোধকারী দলের বিশেষ পরামর্শদাতা। সেখানেও এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। ওয়েভার আবিষ্কার করেন, বাদ্যযন্ত্র বাদকরা বিভিন্ন শব্দের কম্পাঙ্ককে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারেন। আর সেই জিনিসটাই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সোনার অপারেটরদের কাজে নিয়োগ করেছিলেন সঙ্গীতকারদের। না, তাঁদের কারোরই সেভাবে প্রথাগত মিলিটারি ট্রেনিং ছিল না। এই ঘটনাও যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছিল মার্কিন মুলুকে, তবে ওয়েভারের দূরদর্শিতার সাফল্যে ঢাকা পড়ে যায় সবকিছুই…

আরও পড়ুন
জার্মানি ছেড়ে, আমেরিকার হয়ে কাজ করেছিলেন হিটলারের ‘প্রিয়’ বিজ্ঞানীরাই!

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More