যেদিকে চোখ যাবে, সেদিকেই ঘন জঙ্গল। তেলেঙ্গানার রাঘবপুর গ্রামের এই অরণ্যকে সাধারণ চোখে দক্ষিণ ভারতের আর পাঁচটা অরণ্যের চেয়ে আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন প্রকৃতি-পরিবেশের এই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও কোনোভাবে কিছুটা সবুজ বেঁচে গিয়েছে। তবে একটু কাছে গেলেই অবাক লাগতে বাধ্য। দেখা যাবে, বনের চারিদিকে কোনো কাঁটাতারের বেড়া তো নেই-ই, নেই কোনো প্রতিরক্ষা কর্মচারী কিংবা সরকারি নির্দেশের ফলকও। আসলে ৭০ একর আয়তনের এই অরণ্য সুরক্ষার দায়িত্ব এককভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছেন দুশরলা সত্যনারায়ণ নামের এক ব্যক্তি।
মোটামুটি বছর চারেক বয়স থেকে গাছ লাগানো শুরু করেন সত্যনারায়ণ। দেখতে দেখতে গাছের ভিড় বাড়তে থাকে। পূর্ণাঙ্গ অরণ্যের রূপ পায় এলাকাটি। এখন সত্যনারায়ণের বয়স ৬৮ বছর। এতদিন ধরে তিনিই সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে চলেছেন। কাউকে কখনও জঙ্গলের কোনো ক্ষতি করতে দেননি। নিজামের পতওয়ারি বংশের সন্তান সত্যনারায়ণ। পারিবারিক সূত্রেই এই জমির মালিকানা পেয়েছেন তিনি। একসময় তাঁর পূর্বপুরুষের প্রায় ৩০০ একর জমি ছিল। সেখানে পশুপালন, চাষ-আবাদ, জলসেচের কাজ করা হত। তবে বিভিন্ন দেওয়ানি মামলার জেড়ে শেষ পর্যন্ত তা ৭০ একরে এসে ঠেকেছে। আর এই ৭০ একর জমিতেই নিজের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে শুরু করেছিলেন তিনি।
৫ দশক আগেও সবুজের এত আকাল ছিল না তাঁর গ্রামে। সবুজ গাছ আর বন্য পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের মাঝেই বেড়ে উঠেছেন সত্যনারায়ণ। প্রকৃতির মধ্যেই শান্তি খুঁজে পেতেন তিনি। তাই একসময় ঠিক করলেন, হারিয়ে যেতে বসা বন্য বাস্তুতন্ত্রকে তিনি নিজের চেষ্টাতেই রক্ষা করবেন। পরিবারের থেকেও সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। গাছেদের পরিচর্যার বিষয়ে খুঁটিনাটি জানার জন্যই কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। অবশ্য স্নাতক স্তরের পর পেশা হিসাবে বেছে নেন স্থানীয় ব্যাঙ্কের কাজ। আর তার সঙ্গে চলে অরণ্য সংরক্ষণ। তাঁর ৭০ একর জমিতে এখন অন্তত ৫ কোটি গাছের দেখা মেলে। তার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫০০টি পৃথক প্রজাতি। গাছেদের সঙ্গেই রয়েছে নানা পশুপাখি, পতঙ্গও।
সত্যনারায়ণ বলেন, একসঙ্গে অনেক গাছ থাকলেই তাকে অরণ্য বলা চলে না। অরণ্যের নিজস্ব একটি বাস্তুতন্ত্র থাকে। তার জন্য সেখানে মহীরুহের সঙ্গে সঙ্গে ফলের গাছ, ওষধি গাছ, লতা-গুল্মের নির্দিষ্ট অনুপাত থাকা প্রয়োজন। এই পুরো বিষয়টা মাথায় রেখেই তিনি গাছ লাগিয়েছেন। তারপর পাখি, পতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রাণীরা সেই গাছেদের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে গিয়েছে। এই অরণ্যে বট-অশ্বত্থ যেমন আছে, তেমনই রয়েছে পেয়ারা, কুল, ডুমুর, বাঁশের মতো গাছও।
তবে তাঁর এই ৭০ একর জমির দিকে অনেকেরই নজর রয়েছে। এই জমির বিনিময়ে ১০০ কোটি টাকার প্রস্তাবও পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় প্রোমোটাররা বারবার এসে তাগাদা দিয়ে যান। কিন্তু সবাইকেই ফিরিয়ে দেন সত্যনারায়ণ। এমনকি তাঁর ছেলেরা যদি কখনও এই অরণ্য বিক্রি করে দেয়, এই ভয়ে তাঁদেরও অরণ্যের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, এই অরণ্যের কোনো ক্ষতি হতে দেবেন না সত্যনারায়ণ। আর একসময় সমস্ত মানুষ অরণ্যের প্রয়োজন বুঝবে, অরণ্য রক্ষায় এগিয়ে আসবে। এমনটাই মনে করেন তিনি।
Powered by Froala Editor