জার্মানিতে যখন হিটলারের উত্থান হয়, তখন দেশজুড়ে চলছে চরমতম আর্থিক সংকট। ভেঙে পড়েছে গোটা অর্থনৈতিক অবস্থাটাই। এমন একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে হিটলারের ক্ষমতায় আসার মূলমন্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ। আর দাবার চাল ছিল যুব সম্প্রদায়। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই নাৎসি রাজত্ব গড়ে তোলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন হিটলার, তার ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণের কাজ তিনি শুরু করেছিলেন দুইয়ের দশকেই। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ১৯২২ সালে তৈরি করেছিলেন ‘ইয়ুথ লিগ অফ নাৎসি পার্টি’ যুব সংগঠন। পরবর্তীতে যার নামকরণ হয় ‘হিটলার ইয়ুথ’। ১৪-১৮ বছর বয়সী জার্মান কিশোরদের এই সংগঠনই ছিল হিটলারের ভবিষ্যৎ নাৎসি বাহিনীর প্রিমিটিভ সংস্করণ। পরবর্তীতে কিশোরীদের নিয়েও গড়ে উঠেছিল ‘লিগ অফ জার্মান গার্লস’।
তিরিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানির এই যুব সংগঠনই ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ যুবসংগঠন। সেসময় এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ লক্ষ। তবে হিটলারের এই মতাদর্শকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই জার্মানির বুকে গড়ে উঠেছিল আরও এক তরুণ সংগঠন। তরুণ প্রজন্মের প্রতি নাৎসি প্ররোচনার বিরুদ্ধে গান এবং স্বতঃস্ফূর্ত জীবনযাপনের মাধ্যমেই তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এক অভিনব প্রতিরোধ। এডেলভিস পাইরেটস। ভ্যাঙ্কুভার হলোকাস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, নাৎসি জার্মানির বুকে হিটলারবিরোধী বৃহত্তম এই যুবসংগঠন ছিল এডেলভিস পাইরেটস। তবে তার সদস্যসংখ্যা ছিল বড়োজোর কয়েক হাজার। তা সত্ত্বেও নাৎসি জার্মানির পতনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এই তরুণ জার্মানরাই। কিন্তু কেন নাৎসি জার্মানির বুকে গড়ে উঠল এমন একটি সংগঠন?
এডেলভিস পাইরেটসের সকল সদস্যরাই ছিলেন মূলত শ্রমিক শ্রেণীর সন্তান। শুধু অর্থনৈতিক কারণেই নয়, হিটলারের মতাদর্শের সঙ্গে এডেলভিস পাইরেটসের বিরোধ ছিল আরও একটি জায়গায়। ঠিক কেমন? ‘হিটলার ইয়ুথ’ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ গঠন এবং নিয়মাবলীর দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে ব্যাপারটা। শুরুর দিকে হিটলার ইয়ুথ মূলত, খেলাধুলা, শরীরচর্চা এবং ক্যাম্পিং-এর দিকে জোর দিলেও, তিরিশের দশকের শুরু থেকেই সেখানে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল আধাসামরিক ট্রেনিং। বন্দুক চালনা থেকে শুরু করে, গ্রেনেড তৈরি— শেখানো হত সামরিক যুদ্ধের সমস্ত কৌশল। সেইসঙ্গে শৃঙ্খলবদ্ধ জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বিনোদন। নাৎসি জাতীয়তাবাদী গান ছাড়া অন্য কোনো গান শোন, বই পড়া— সবই ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি কিশোর, কিশোরীদের সম্পর্কের মধ্যেও স্পষ্ট বিভাজন রেখা তুলে দিয়েছিলেন হিটলার। শৃঙ্খলবদ্ধ এই জীবনদর্শন এবং লিঙ্গবিচ্ছিন্নতাকেই প্রাথমিকভাবে প্রত্যাখান করেছিলেন এডেলভিস পাইরেটসের তরুণরা। তবে সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁদের কার্যকলাপ। পরবর্তীতে নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এককথায় সম্মুখ সমরেই নেমেছিলেন এই জার্মান তরুণরা।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই মিত্রশক্তির বিমান থেকে নাৎসি বিরোধী লিফলেট ছড়ানো হত জার্মানির আকাশে। নাৎসি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে ফেলার আগেই, সেগুলি সংগ্রহ করতেন এডেলভিস পাইরেটসের সদস্যরা। তারপর সেই লিফলেট বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন তাঁরা। বহু ইহুদিকে পরিচয় গোপন করে জার্মানি থেকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতেও সাহায্য করেছিল এডেলভিস পাইরেটস।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৩৯ সালে, আঠারো বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের ‘হিটলার ইয়ুথ’-এ যোগদান বাধ্যবাধকতামূলক করা হয় নাৎসি জার্মানিতে। সেসময় ধীরে ধীরে ভাঙন ধরে এডেলভিস পাইরেটসের সংগঠনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেককে বাধ্য হয়েই যোগ দিতে হয়েছিল সেনাবাহিনীতে। তবে সেখানেও থেমে ছিল না বিপ্লবী কার্যকলাপ। বিভিন্ন নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকেই ইহুদি ও শ্রমিক বন্দিদের মুক্ত করার কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে ছিল এডেলভিস পাইরেটসের তরুণ ‘সেনারা’। পাশাপাশি নাৎসি সেনাশিবির থেকে আগ্নেয়াস্ত্র চুরি করে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিরোধী সংগঠনের কাছে সেসব পৌঁছে দিতেন তাঁরা। অন্যদিকে অনূর্ধ্ব আঠারো বছর বয়সীরা জার্মানির বুকে তখন চালিয়ে যেতেন নাৎসি বিরোধী প্রচার। এডেলভিস পাইরেটসদের তত্ত্বাবধানে জার্মান আধিকারিকদের গাড়িতে হামলার একাধিক ঘটনার কথাও উল্লেখ পাওয়া যায় ভ্যাঙ্কুভার হলোকাস্ট ইনস্টিটিউটের নথিতে। তাছাড়াও পশ্চিম জার্মানির দেওয়ালে দেওয়ালে সেসময় ছেয়ে গিয়েছিল তাঁদের করা গ্রাফিতি।
তবে খুব বেশিদিন আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হয়নি পাইরেটসদের। জার্মানির সিক্রেট নাৎসি পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের হাতে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ধরা পড়েছিলেন এডেলভিস পাইরেটসের একাধিক সদস্য। কারাদণ্ডের পাশাপাশি অনেককে সম্মুখীন হতে হয়েছিল মৃত্যুদণ্ডেরও। সেই শহিদদের তালিকায় অন্যতম ছিলেন সোফি স্ক্রল। আর যাঁরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন, বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিতে তাঁদেরও কোণঠাসা করে রেখেছিল নাৎসি মনস্ক সমাজ।
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকদের একটি ছোট্ট সংগঠন ‘হোয়াইট রোজ’ প্রতিরোধী তরুণদের এই কৃতিত্ব উদযাপন করে এসেছেন প্রতিবছর। উল্লেখ্য, এই সাদা গোলাপই ছিল এডেলভিস পাইরেটসের প্রতীক। তবে আশ্চর্যের বিষয় জার্মান তরুণদের এই যুব-আন্দোলন অনালোচিতই থেকে যায় জার্মানির ইতিহাস পাঠ্যে। বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ষাট বছর পর নব্বইয়ের দশকে প্রথম সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এডেলভিস পাইরেটসকে। প্রকাশ করা হয়েছিল সরকারি নথিও। গোটা বিশ্বজুড়ে তরুণ এই সংগঠনকে নিয়ে চর্চা এবং গবেষণার শুরু হয় তারপর থেকেই। প্রকাশ্যে আসে নাৎসি জার্মানির অজানা নানান তথ্য। বিশ্বযুদ্ধের ৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই, এডেলভিস পাইরেটসের যুবরাই আসলে পথ দেখিয়েছিল আজকের প্রগতিশীল ও চিন্তাশীল জার্মানি গড়ে তোলার…
Powered by Froala Editor