৫০-এ পা বারকোডের, এই আশ্চর্য প্রযুক্তির প্রবর্তক কে?

পণ্যের গায়ে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর ছাপা কালো রঙের সমান্তরাল কিছু সরলরেখা। আদতে যেগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রস্থের আয়তক্ষেত্র। বৈদ্যুতিন স্ক্যানের সামনে সেই ছবি তুলে ধরলেই, অনায়াসে কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে উঠছে পণ্যের দাম এবং অন্যান্য তথ্য। বারকোড (Barcode)। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রযুক্তির সঙ্গে সকলেই পরিচিত আমরা। বই থেকে শুরু করে যে-কোনো প্রসাধনী, মুভি-থিয়েটারের টিকিট, এমনকি প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্যেও নজরে পড়ে এই প্রযুক্তির প্রতিফলন। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক কে? কবে থেকেই বা চালু হল এই প্রযুক্তি?

৩ এপ্রিল, ১৯৭৩। খাতায়-কলমে এই দিনটিকেই ধরে নেওয়া হয় ‘বারকোড’-এর জন্মদিন হিসাবে। কারণ এইদিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছিল বারকোড। অর্থাৎ, দেখতে দেখতে ৫০-এ পা দিল এই প্রযুক্তি। আর বারকোডেকে বাণিজ্যের মূল ধারায় সামিল করার নেপথ্যে ছিলেন আইবিএম-এর সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার জর্জ লরার। যদিও এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক কে— তা নিয়ে রয়েছে দীর্ঘ বিতর্ক। আসলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তি প্রচলনের প্রায় দু’দশক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল গবেষণা। বাজারে এসেছিল একাধিক প্রোটোটাইপ। ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাস। 

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে সবেমাত্র। নতুন করে স্বাভাবিকতায় ফিরছে পৃথিবী। একটু একটু করে বিশ্বায়নের পথে হাঁটতে শুরু করেছে পৃথিবী। বাজার ছেয়েছে দেশ-বিদেশের পণ্যে। কিন্তু কোন পণ্যের দাম কত— তা নির্ধারণ করাই রীতিমতো দুষ্কর কাজ হয়ে দাঁড়ায় বিক্রেতাদের কাছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সুপার মার্কেটের চেকআউট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন পড়ে যেত হামেশাই। এমনকি লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন প্রবীণরা— রয়েছে সেই উদাহরণও। আর সেখান থেকেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন এক প্রযুক্তির, যা দ্রুত স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলে দেবে কোনো বিশেষ পণ্যের নির্ধারিত মূল্য। 

সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন ফিলাডেলফিয়ার ডেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই স্নাতক বার্নার্ড সিলভার এবং নরম্যান জোসেফ উডল্যান্ড। ১৯৫২ সালে তাঁদের হাত ধরেই প্রথমবার আবিষ্কৃত হয় বারকোডের প্রোটোটাইপ। পেটেন্টও পেয়েছিলেন সিলভার ও উডল্যান্ড। অবশ্য এই প্রযুক্তিকে বারকোড বলা যায় কিনা— সন্দেহ রয়েছে তা নিয়ে। কারণ, সমান্তরাল রেখা নয়, বরং সিলভার-উডল্যান্ডের তৈরি এই বিশেষ কোডটি ছিল বেশ কিছু সমকেন্দ্রিক বৃত্তের সমাহার। দুই তরুণ উদ্ভাবক জানিয়েছিলেন, স্কাউটের সজ্জা ও মোর্স কোড থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই প্রযুক্তি তৈরি করেছিলেন তাঁরা। 

অবশ্য ব্যবহারিকভাবে ততটাও সফল হয়নি এই প্রযুক্তি। লেজার চালিত অপটিক্যাল স্ক্যানিং-এর সময় অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা হত মূল পণ্য চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে। ফলে, পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রযুক্তি চালু করা হলেও, বেঁধে বসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রেতারা। পাশাপাশি বাড়তি খরচ করে স্ট্যাম্প লাগানোর বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাও। ফলে ষাটের দশকেও বাস্তবায়িত হয়নি এই প্রযুক্তি। 

পরবর্তীতে সিলভানিয়া ইলেক্ট্রিকস ল্যাবরেটরির প্রযুক্তিবিদ জেডিভ কলিন্সের সৌজন্য বাজারে আসে বারকোড স্ক্যানিং-এর ভিন্ন একটি প্রযুক্তি। স্ক্যানার থেকে উৎপন্ন আলোর ঝলকানির মাধ্যমে বারকোড স্ক্যান করা হত এই পদ্ধতিতে। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রেলগাড়িতে ব্যবহার করা হয় এই পদ্ধতি। অন্যদিকে ১৯৭৩ সালে সমকেন্দ্রিক বৃত্তের পরিবর্তে সমান্তরাল রেখার বারকোড চালু করেন আইবিএম-এর বিজ্ঞানী জর্জ লরার। বলতে গেলে, আজকের আধুনিক বারকোডের পিছনে এই দুই বিজ্ঞানীরই সমান অবদান রয়েছে। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন মার্কিন সংস্থা ও সংবাদপত্র বারকোডের আবিষ্কারক হিসাবে পৃথক পৃথকভাবে চিহ্নিত করেন এই দুই কিংবদন্তিকে। 

তবে আইবিএম-এর এই প্রযুক্তি ১৯৭৩ সালে বাজারে এলেও, তা বাণিজ্যিকভাবে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল পরের বছর। আর এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছিল ওহিওর নিকটবর্তী মার্শের একটি সুপারমার্কেট। প্রথম পণ্য হিসাবে স্ক্যান করা হয়েছিল ১.৩৯ ডলার মূল্যের ব্যাগ রিগলির একটি ‘জুসি ফ্রুট চিউয়িং গাম’। আজও যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে সেই ঐতিহাসিক বারকোড স্ক্যানার। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More