কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ নতুন দিশা দেখাচ্ছেন বাঙালি গবেষক

“পারফেক্ট বা আদর্শ কোয়ান্টাম অবস্থা তৈরির জন্য পরম শূন্য তাপমাত্রার প্রয়োজন। তবে বাস্তবে শূন্য কেলভিন বা -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তার কাছাকাছি তাপমাত্রায় কোয়ান্টাম অবস্থা তৈরি করা হয়। এই অবস্থায় যদি সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাশির পরিমাপ করি তবে ভালো ফলাফল পাব। কিন্তু কয়েক মিলিসেকেন্ডের তফাতেও শক্তিস্তর পরিবর্তন হয়ে যায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে এই ‘ডিকোহিরেন্স’-ই অন্যতম চ্যালেঞ্জ।”

বলছিলেন বাঙালি গবেষক ডঃ প্রত্যয় ঘোষ (Dr. Pratyay Ghosh)। জন্মসূত্রে প্রত্যয় মেদিনীপুরের বাসিন্দা। অবশ্য তাঁর বর্তমান ঠিকানা জার্মানির উর্জবার্গ শহর। ২০২১ সাল থেকে উর্জবার্গের জুলিয়াস ম্যাক্সিমিলিয়নস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত তিনি। আর গবেষণার ক্ষেত্র কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (Quantum Computing)। সম্প্রতি ‘কোয়ান্টাম নয়েজ’ অপনয়নের (Quantum Noise Cancellation) এক নতুন পন্থার হদিশ দিলেন প্রত্যয়। আর যুগান্তকারী এই গবেষণার জন্যই টেক-জায়েন্ট আইবিএম আয়োজিত ‘কোয়ান্টাম ওপেন সায়েন্স প্রাইজ’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার পেল প্রত্যয়ের নেতৃত্বাধীন উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-দল। 

প্রশ্ন থেকে যায় কী এই কোয়ান্টাম নয়েজ? কেনই-বা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে আধুনিক বিজ্ঞানী মহল? বাস্তব দুনিয়াতেই-বা কী প্রভাব ফেলতে চলেছে এই গবেষণা?

“আমার যে-কম্পিউটার ব্যবহার করি, সেগুলি বায়োনারি ডিজিটের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহ এবং পরিচালনার জন্য মূলত ০ এবং ১— এই দুটি সংখ্যা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার শুধুমাত্র এই দুই মৌলিক বিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কিউবিট একই সময়ে ০ এবং ১ দুটি অবস্থাকেই উপস্থাপন করতে পারে”, জার্মানি থেকেই সহজ ভাষায় গোটা বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন বাঙালি গবেষক। 

আরও পড়ুন
জানা যাবে ভূগর্ভের সূক্ষ্মতম পরিবর্তন! আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক কোয়ান্টাম সেন্সর

১৬ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার। গুয়াডালুপে আর্কিটেকচার।


০ ও ১-এর এই উপরিপাতের এই প্রক্রিয়াই কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে ভবিষ্যৎ কম্পিউটারের ক্ষমতা এবং গতি। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, স্যাটেলাইটের বা কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করতে যেখানে সাধারণ কম্পিউটারের সময় লাগে কয়েক মাস, সেই তথ্য মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিশ্লেষণ করতে সক্ষম সুপার-কম্পিউটার। শুনতে অতি-বাস্তব লাগলেও সত্যি। আর সেই কারণেই ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, চিন এবং ভারতেও চলছে সুপার-কম্পিউটার তৈরির লড়াই। গুগল, আইবিএম-এর মতো টেক-জায়েন্টরা কোটি কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে এই গবেষণায়। তবে চূড়ান্ত সাফল্য এখনও হাতে আসেনি প্রযুক্তিবিদদের। কিন্তু কী সেই চূড়ান্ত সাফল্য?

আরও পড়ুন
খুলবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর নতুন দিগন্ত, যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি গবেষকের

কথা হচ্ছে ‘কোয়ান্টাম নয়েজ’ নিয়ে। মাইক্রোফোনে গান কিংবা কোনো কথা রেকর্ড করার সময় যেমন অবাঞ্ছিত শব্দ ঢুকে পড়ে, বিকৃত করে তোলে মূল শব্দ তরঙ্গকে— কোয়েন্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও ঘটে এই একই ঘটনা। তবে এক্ষেত্রে বাহ্যিক শব্দের বদলে এই ‘নয়েজ’-এর জন্য দায়ী বিভিন্ন অবাঞ্ছিত শক্তিস্তর। শূন্য কেলভিন তাপমাত্রার থেকে যত তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, ততই বাড়তে থাকে এইধরনের অবাঞ্ছিত শক্তিস্তরের উপস্থিতি। মূল কোয়ান্টাম অবস্থার শক্তিক্ষয়ের কারণেই তৈরি হয় এই ধরনের শক্তিস্তরগুলি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ডিকোহেরেন্স’। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির ক্ষেত্রে এই সমস্যাই সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা গবেষকদের সামনে। যে-সমস্যার কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছিলেন প্রত্যয়। 

আরও পড়ুন
১০ হাজার বছরের কাজ ৩ মিনিটে, গুগল নিয়ে এল কোয়ান্টাম কম্পিউটার

বাঁ দিক থেকে : জানিস সয়ফার্ট, আলেকজান্ডার ফ্রিৎজ়স, আলেকজান্ডার স্টিগমায়ার, রিচার্ড স্ট্রুঙ্ক, প্রত্যয় ঘোষ


উর্জবার্গের গবেষকরা কাজ করেছেন এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতেই। তৈরি করেছেন কোয়ান্টাম নয়েজ অপনয়ন বা বর্জনের এক বিশেষ পদ্ধতি। আর এই নতুন উদ্ভাবনীর মূল কারিগর প্রত্যয়। প্রত্যয়ের পাশাপাশি এই দলে ছিলেন গবেষক জানিস সয়ফার্ট, আলেকজান্ডার ফ্রিৎজ়স, আলেকজান্ডার স্টিগমায়ার, রিচার্ড স্ট্রুঙ্ক। 

“আমরা যখন প্রথম কোয়ান্টাম স্টেট তৈরি করি তখন এরর-এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ শতাংশ। সেটা নয়েজের জন্যই। তখন আমার মনে হয়, আমাদের অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে এই ত্রুটি অপনয়নের জন্য”, জানালেন প্রত্যয়। কিন্তু কী সেই পদ্ধতি? এক-কথায় উত্তর, ‘সিমেট্রি’ বা সমতা। তাঁর কথায়, “স্পেস ট্রান্সলেশন সিমেট্রি থেকে টাইম ট্রান্সলেশন সিমেট্রি— আমাদের গোটা জগৎটাই কাজ করে বিভিন্ন সমতার ওপর। এই সমতাগুলো ইনহেরেন্ট বা সহজাত পদার্থবিদ্যার জগতে। একইভাবে আমাদের তৈরি কোয়ান্টাম অবস্থায় কী কী সমতা রয়েছে— সেটার অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম আমরা।”

কথায় কথায় জানা গেল, ১৬ কিউবিটের কোয়ান্টাম আর্কিটেকচারে বিশেষ কোয়ান্টাম অবস্থা তৈরি করে কয়েক হাজার তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন প্রত্যয় এবং তাঁর দলের গবেষকরা। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই উপলব্ধ ফলাফলকে ভিন্ন ভিন্ন কোয়ান্টাম স্তরে বিন্যস্ত করেন তাঁরা। যে-শক্তিস্তরগুলি সমতা তৈরি করছে— কেবলমাত্র সেগুলিকেই ব্যবহার করেন গণনার কাজে। অসম শক্তিস্তর বা পদার্থবিদ্যার কথায় ‘এনার্জি পিক’-গুলিকে বাদ দেন ‘নয়েজ’ বা ‘এরর’ হিসাবে। তাতেই সার্বিক ত্রুটির পরিমাণ নেমে আসে ৫ শতাংশে। প্রত্যয়ের কথায়, “আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল এই নয়েজগুলি কোন শক্তিস্তরের জন্য তৈরি হয়েছে, সেটা চিহ্নিত করে, সংশ্লিষ্ট শক্তিস্তরের সঙ্গে সেগুলিকে যোগ করা।”

কোয়ান্টাম অবস্থার শক্তিস্তরের বিন্যাস


উল্লেখ্য, কোয়ান্টাম নয়েজ–ক্যানসেলেশন বা অপনয়নের একাধিক পন্থাই বর্তমানে হাজির রয়েছে গবেষকদের হাতে। তবে কোয়ান্টাম নয়েজ অপনয়নের জন্য সমতার ব্যবহার এই প্রথম। শুধুমাত্র এই পদ্ধতি অনন্যই নয়, পাশাপাশি এই গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়োগও তুলনামূলকভাবে সহজ। অন্যদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে কিউবিটের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, ততই বৃদ্ধি পায় অবাঞ্ছিত শক্তিস্তর বা নয়েজের পরিমাণও। সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি গবেষকদের বিশেষ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে আগামীদিনে। কাজেই বলার অপেক্ষা থাকে না, প্রত্যয়ের এই গবেষণা খুলে দিতে চলেছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর এক নতুন দিগন্ত…

ছবি ঋণ - ডঃ প্রত্যয় ঘোষ, অঙ্কিতা ঘোষ

Powered by Froala Editor

More From Author See More